গাজী শাহনেওয়াজ
পোশাক শিল্পে বঞ্চনার ক্ষোভ
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প ঘিরে অসন্তোষ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এর মূলে রয়েছে নানা সমস্যা, সংকট ও শ্রমিকদের বঞ্চনার ক্ষোভ। পাশাপাশি আছে পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বন্দ্ব। আগে এটা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন নেওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপির লোকজন। এ অবস্থায় তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, খাতটি নিয়ে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে। তারা বলেছে, এ সংকট দ্রুত সমাধান করা সম্ভব না হলে শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তাই রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
এদিকে অসন্তোষ ও অস্থিরতার মূলে মোটাদাগে চারটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের প্রাপ্য না দিতে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল চক্রকে আর্থিক বিনিময়ে লালন করা, টিফিনের টাকা দিতে বৈষম্য দূর না করা, মাসিক বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের ভিন্নতা এবং সুবিধাজনক বেতনের অফার পেলেও নতুন কর্মস্থলে যোগদানে প্রতিবন্ধতা তৈরি করা। এর বাইরে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে বায়ারদের ভাগিয়ে অন্যদেশে স্থানান্তরে দেশি-বিদেশিদের ষড়যন্ত্রও দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দুই শতাধিক পোশাক করাখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। মূলত গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় এ অসন্তোষ বেশি ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত শনিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে কারো ফাঁদে পা না দিতে আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, রবিবার (গতকাল) থেকে বন্ধসহ সব কারখানার কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার। কিন্তু শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার অধিকাংশ পোশাক কারখানা উৎপাদনে ফিরলেও বন্ধ ছিল ২০টি পোশাক কারখানার কাজ। তবে শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ।
গতকাল সকালে শিল্পাঞ্চলের পোশাক কারখানা ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকে খোলা কারখানার শ্রমিকরা কর্মস্থলে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেছেন। তবে কারখানাগুলোয় নাশকতা ও সহিংসতা এড়াতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম জানান, শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সড়ক অবরোধসহ কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো শ্রমিক অসন্তোষসহ কর্মবিরতির খবরও পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে। বন্ধ থাকা ২০টি কারখানার মধ্যে ১৮টি অনির্দিষ্টকালের জন্য শ্রম আইনে বন্ধ রয়েছে। আর বাকি দুটি কারখানায় দেওয়া হয়েছে সাধারণ ছুটি। শিল্পাঞ্চলে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। এছাড়া শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপদেষ্টাদের আহ্বানে মালিক পক্ষ তাদের কারখানাগুলো খোলা রেখেছে এবং শ্রমিকরা স্বাভাবিক নিয়মে তাদের কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের বঞ্চনা নিরসন না হলেও যেকোনো সময় আবার অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।
শনিবারের সভা থেকে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকেই সহশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সভায় শ্রমিকদের পক্ষে নানা দাবি তুললেও কারও উসকানিতে পা না দিয়ে কারখানার উৎপাদন চালু রাখতে শ্রমিকদের কাজে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান শ্রমিক নেতারা। একই সঙ্গে সরকারকে কঠোর হওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শ্রম অসন্তোষ নিরসণে কাজ করছেন তারা। শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানান, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ধ্বংসে ষড়যন্ত্র করছে রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী প্রতিবেশী দেশ।
পোশাক শিল্প নিয়ে কাজ করা একাধিক নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্যতা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেয় না মালিকরা। এর মধ্যে টিফিন এলাউন্স একটি। কোনো গামেন্টস মালিক টিফিন বাবদ একজন শ্রমিককে দিচ্ছে ২০ টাকা। একই সুবিধা ভোগ করা অন্য একজন মালিক দিচ্ছেন ৩০ টাকা এবং অপর আরেকজন দিচ্ছেন ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। টিফিনের এ বৈষম্য একযুগ ধরে চলে আসছে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও সেটি অগ্রাহ্য করে চলছেন মালিকরা। একইভাবে কোনো কোনো গামেন্টস মালিক শ্রমিকদের মাসিক বেতন দিচ্ছেন ১০ তারিখে।
দেখা যাচ্ছে, পাশের আরেকটি কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে ১২ তারিখ কোনো কোনোটিতে আবার ১৫ তারিখে। একইভাবে, বেতন বৈষম্য রয়েছে পোশাক কারখানা ভেদে। এ কারণে অনেক শ্রমিক মাসিক বেতন নিয়ে আরো বেশি বেতনের অফারে চাকরি পাওয়ার কারণে পুরোনো কারখানায় যান না। কিন্তু ওই শ্রমিকের কাছে সংশ্লিষ্ট অফিসের পরিচয়পত্রসহ চুক্তিনামা থাকলেও তা ফেরত না দিয়ে নিজের সংরক্ষণে রেখে দেন। কয়েকদিন ওই শ্রমিক কাজে যোগ না দিলে দেখা যায়, মালিক পক্ষ থেকে ওই শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। সময় বুঝে মালিকদের কাজের সুবিধার্থে তৈরি সুরক্ষা অ্যাপে তার নাম পরিচয় দিয়ে ব্লাকলিস্টে ফেলে রাখেন। এটি দেখার পর নতুন যে কর্মস্থলে তার চাকরি হয়েছিল ওই মালিক তাকে কাজে যোগ দিতে দেন না।
প্রতি মাসেই ব্লাকলিস্টের তালিকায় এমন হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যান। কিন্তু এ নিয়ে ছোট ছোট মালিক পক্ষ বড় বড় শিল্প মালিকদের অনুরোধ জানালেও তা মানতে নারাজ তারা। বলেন, আমার এখানে যে ক্ষতি করে দিয়ে অন্যত্রে চলে যাচ্ছে। অন্যত্রে যে একই কাজ করবে না এ নিশ্চয়তা কে দিবেন। এ নিয়ে মালিক, শ্রমিক ও ছোট ছোট শিল্প মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের।
এছাড়া শ্রমিকরা হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী মুজুরি দিতে চান না মালিকরা। কারণ হিসেবে বলা হয়, যে কারখানায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করে শ্রমিক প্রতি ২০ টাকা বাড়ালে মাস শেষে ওই মালিকের অতিরিক্ত ২০ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় হয়। তাই প্রকৃত শ্রমিকদের বঞ্চিত করার জন্য মধ্যস্বত্বভোগী একটি গ্রুপ তৈরি করেন মালিকরা। এদের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। মাসিক ৩ থেকে ৫ লাখ দিয়ে থাকেন।
এ গ্রুপকে মালিক পক্ষ থেকে নিদের্শনা দেওয়া থাকে, বেতন বৈষম্য থেকে যদি শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে তাহলে তারা এ বিদ্রোহ দমনে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী ওই মহলকে নিদের্শনা থাকে, তারা কোনো অবস্থায় শ্রমিকদের পক্ষে সুবিধা নিয়ে কথা বলতে পারবে না।
ঢাকা-২০ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি সালাউদ্দিন বাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসার পর থেকেই পোশাক কারখানায় অসন্তোষ শুরু হয়েছে। মূলত কয়েকটি কারণে শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট। এক এক কারখানায় টিফিন এলাউন্সে ভিন্নতা রয়েছে। একই ভাবে, বেতন দেওয়া হয় ভিন্ন সময়ে। আবার একজন শ্রমিক ভালো বেতনে অন্যত্রে চাকরি পেলেও তাকে ব্লাকলিস্ট করা হচ্ছে। এমনকি শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে মধ্যস্বত্বভোগী বাহিনী গড়ে তোলেন মালিকরা। এতদিন মালিকদের এসব অন্যয় হজম করলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমিকরা তা হজম করতে চাইছেন না। তারা সুবিধা আদায়ের মোক্ষম সময় বেছে নিয়ে আন্দোলন ও ভাঙচুর করছেন।
তিনি আরো বলেন, ব্লাকলিস্ট করার কারণে অনেক শ্রমিক কাজে যোগ দিতে না পারলেও তাদের কাছে পরিচয়পত্র থাকায় যে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। চাকরিচ্যুতরা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ওই আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়পত্র থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। আমরা রাস্তায় পাহারা বসিয়ে কারখানা সচল রাখার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপনারা রাস্তায় থাকলে আমাদের নানা সমস্যা হচ্ছে। আপনারা সেইফ পজিশনে থেকে দায়িত্ব পালন করেন প্রয়োজন হলে আপনাদের ডাকব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারের এক ব্যক্তি বলেন, শ্রমিকদের বঞ্চনার পাশাপাশি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব থেকে এ অসন্তোষ। আওয়ামী লীগের কিছু ইন্ধন আছে। তারা কারখানা ঝুট নিয়ন্ত্রণ করত এখন বিএনপির লোকজন ঢোকার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের লোকজন বলছে, যেহেতু আমরা খেতে পারব না তোদেরও খেতে দেব না। ফলে কৌশলে অসন্তোষ লাগিয়ে দিচ্ছে। কারণ গত ১৫ বছরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের লোক বসিয়ে রেখেছে।
শ্রমিক বিশেষজ্ঞ রুহুল আমিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের এ অসন্তোষ হঠাৎ না। এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কারণ বেতন বৃদ্ধি নিয়ে চরম প্রতারণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করার কথা ছিল ২৩ হাজার টাকা হঠাৎ তা কমিয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হলো। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। এসব নানা বঞ্চনা থেকেই এ ক্ষোভের সৃষ্টি।
"