কূটনৈতিক প্রতিবেদক
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের বৈঠক * আরো ২০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তায় চুক্তি
সবদিক থেকেই এখন নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে দেশ। এ অবস্থায় অর্থ, বাণিজ্য এবং রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর সার্বিক সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। এ সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ঢাকায় সফররত উচ্চপর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গতকাল রবিবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আলোচনা হয়েছে। সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করতে আগ্রহী। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে এদিনই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গড়ে উঠবে এক নতুন বাংলাদেশ। চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সাহাবউদ্দিন এবং ইউএসএআইডির পক্ষে সই করেন রিড জে অ্যাসচলিম্যান। অনুষ্ঠানে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস প্রতিনিধিদলকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সংস্কার এবং সবকিছু নতুন করে শুরু করতে এবং আর্থিক খাত, বিচার বিভাগ, পুলিশ বাহিনী ও অন্য প্রতিষ্ঠান সংস্কারে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। এটি আমাদের এবং ইতিহাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তিনি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের উল্লেখ করে বলেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের কাছে প্রধান উপদেষ্টা তার সরকারের সংস্কার উদ্যোগের রূপরেখা বর্ণনা করেন। ড. ইউনূস বলেন, ভোট জালিয়াতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, দুর্নীতি দমন সংস্থা এবং সংবিধান সংশোধনে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকার সাবেক আমলের দুর্নীতিবাজদের লুণ্ঠিত ও পাচার করা সম্পদ ফেরত আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
দুর্নীতি মোকাবিলায় সরকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা দুর্নীতির সাগরে ছিলাম।
সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধিদল অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে জানায়, ওয়াশিংটন এসব সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন করে। তারা সংস্কার কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রম সমস্যা, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রধান উপদেষ্টার নিউইয়র্ক সফর নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে আরো ছিলেন সহকারী মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের পরিচালক জেরোড ম্যাসন।
ড. ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন তার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফী সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব ও এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী।
ড. ইউনূস ছাড়াও অর্থ এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে মার্কিন প্রতিনিধিদলের।
পরে চুক্তির বিষয়ে ইউএসএআইডির তরফে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তার অর্থ কাজে লাগানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হলো বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহযোগিতা করা।
ইউএসএআইডি আরো বলেছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আলোকে এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দ্য ডেভেলপমেন্ট অবজেকটিভ গ্র্যান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (ডিওএজি) বা উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুদান চুক্তির ষষ্ঠ সংশোধনী হিসেবে এই চুক্তি সই হয়েছে। এই চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত। সেই চুক্তির আলোকে বাংলাদেশকে ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার সহায়তা দেওয়ার কথা। এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি সংশোধনীর আলোকে ৪২৫ মিলিয়ন বা ৪২ কোটি ৫০ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে। এবার ষষ্ঠ সংশোধনীর আলোকে অতিরিক্ত ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউএসএআইডি ও ইউএসডিএর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা শীর্ষক একটি চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, সুশাসন, খাদ্য নিরাপত্তার মতো বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ পরে সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মূলত রাজস্ব ও আর্থিক খাত নিয়ে কথা হয়েছে। আর্থিক খাতের সংস্কার ও সহযোগিতা নিয়ে কথা হয়েছে। বাণিজ্য নিয়েও কথা হয়েছে; রপ্তানি বহুমুখীকরণসহ কারিগরি সহায়তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাজার অনুসন্ধানও আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে জসীম উদ্দীন বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও সরকারের সংস্কার বিষয়ে যে ধ্যানধারণা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এই সফর একটি ভিত্তি। সামনে আমরা এই আলোচনাকে বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাব।
পাচার হওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা বড় আকারে আর্থিক খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পাচার হওয়া অর্থসহ অন্য বিষয় নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে, সেটি হয়তো আমরা ব্যবহার করব কিন্তু আলাপ-আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। এর চূড়ান্ত রূপ পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, প্রতিনিধিদলের এই সফরে প্রথম যে আশ্বাস, সেটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সব কটি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি সফর করেছেন। এই সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন আছে এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন আছে। আমরা যদি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই এগুলো আমাদের জন্য প্ল্যাটফরম।
শ্রম আইন নিয়ে বৈঠক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, শ্রম আইন নিয়ে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি সেগুলো তাদের অবহিত করেছি এবং তারা পদক্ষেপ সম্পর্কে নোট নিয়েছেন। এগুলো তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে স্বীকৃতি দেন। এক্ষেত্রে এ আলোচনাটা কন্টিনিউ করবে।
তৈরি পোশাক খাতে যে অস্থিরতা চলছে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে কি না এবং জিএসপি প্লাস ফিরে পাওয়া নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, আজকের বৈঠকে এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। জিএসপি নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। এটার যে প্রক্রিয়া এ সম্পর্কে কথা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ক্রয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি জানান, ডিএফসি (ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন) থেকে অর্থায়ন পাওয়া নিয়ে একটা সাধারণ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি।
র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে এবং নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, র্যাবের সংস্কার নিয়ে যেসব কাজকর্ম করছি, সেগুলো সম্পর্কে তাদের অবহিত করেছি। এটা একটা চলমান আলোচনা। নির্বাচন নিয়ে কোনো সহায়তা চাওয়া হয়নি।
বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জসীম উদ্দিন জানান, আমরা বলেছি, এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি ইস্যু। এটার সমাধান হওয়া উচিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্প্রতি যেসব উন্নয়ন হয়েছে সেটার বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
"