নিজস্ব প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি

  ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পোশাক খাতে অস্থিরতা

৫৭ কারখানায় ছুটি, বন্ধ আরো ৫৭টি

সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ * কাশিমপুরে বেক্সিমকোর বিগবস কারখানায় আগুন

বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের ১১৪টি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। বাকিগুলোয় শ্রমিকরা উপস্থিত হয়েও কাজ না করায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) এক পরিচালক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, বন্ধ থাকা ১১৪টি কারখানার মধ্যে ১১১টি সাভার, আশুলিয়া ও জিরানি এলাকার। বাকি তিনটি কারখানা গাজীপুরের। শ্রমিক আন্দোলনে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অশান্ত সাভারের আশুলিয়া, জিরানি ও গাজীপুর শিল্প এলাকায় ১১৪টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের তিনটি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে ৫৭টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। আর ৫৭টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা মঙ্গলবার পর্ষদ সভা করে গতকাল বুধবার কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে নেতাদের একটি অংশ আশুলিয়ার মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রম আইনের নির্দিষ্ট ধারায় কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী গতকাল কারখানা খোলা হয়নি। তবে সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গতকাল সকালে নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। তবে কারখানায় উপস্থিত হওয়ার পরও কাজ না করায় ৫৭টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় ৫৪টি কারখানা বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ এসব কারখানার শ্রমিকরা কাজ না করলে মজুরি পাবেন না।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘যারা পারছেন, তারা কারখানা চালাচ্ছেন। আর যারা পারছেন না, কারখানা ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন।’ আগের দিন মঙ্গলবার অধিকাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিলেও দুপুরের পর অনেক কারখানায় অসন্তোষ দেখা দেয়। ৩২টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকেন। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করলে তারা বেরিয়ে যান। কারখানা মালিকরা জানান, এরই মধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আশুলিয়ায় ৪২টি কারখানা বন্ধ ছিল। এছাড়া গাজীপুরের ২৫টি কারখানায় কাজ হয়নি শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে। এদিন বেতনের দাবিতে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন। মঙ্গলবার এখানে বেতন দেওয়ার কথা ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, অর্থ নগদ করাতে না পারায় শ্রমিকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। আশুলিয়ার জিরাবো, নিশ্চিন্তপুর, নরসিংহপুর, সরকার মার্কেট, জামগড়া, বাইপাইলসহ আশপাশ এলাকায় ছিল যৌথবাহিনীর টহল। সকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করেন। তবে কিছু কারখানার ফটকে লাগানো রয়েছে বন্ধের নোটিস।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়েছে। কিছু কারখানায় শ্রমিক-মালিকের মধ্যে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। এ আলোচনা ফলপ্রসূ হলে সেখানে পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তা জানান, শ্রমিকরা এমন কিছু দাবি উপস্থাপন করছেন, যা মেনে নেওয়া কঠিন। শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা নিয়ে গত সোমবার সন্ধ্যায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে একটি জরুরি বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন কারখানা মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও রাজনৈতিক নেতারা। বৈঠকে শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আশুলিয়ার সব পোশাক কারখানা মঙ্গলবার খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী প্রায় সব কারখানা খুলে দেওয়া হলেও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় ৪২টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সোমবারের বৈঠকে শ্রমিকদের চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। টিফিন বিল ও হাজিরা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য রাখা হবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। আর কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করলে তার ব্যাপারে রেস্ট্রিকশন থাকবে না, যাতে সে অন্যত্র সহজে চাকরি পেতে পারে। শ্রমিকদের অভিযোগ, সরকার ২০১৮ সালে শ্রমিকদের বেতনের গেজেট প্রকাশের পর ২০২৩ সালে সেটি সংশোধন করে। এতে শ্রমিকদের দক্ষতা অনুযায়ী ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটেগরিতে বেতন নির্ধারিত হয়। কিন্তু ওই গেজেট অনুযায়ী তারা বেতন পাচ্ছেন না। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, ‘শ্রমিকরা হঠাৎ করে আন্দোলনে নেমেছেন। বিভিন্ন স্থানে তারা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ।’

এদিকে গাজীপুরের কাশিমপুরের ভবানীপুর এলাকায় বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগানো হয়েছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় এ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের তাড়িয়ে দেন। কাশিমপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা অন্যান্য কারখানাও বন্ধ করতে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালান। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চেষ্টা করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বুধবার সকাল থেকে বকেয়া বেতনের দাবিতে বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। তারা সড়কও অবরোধ করেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় একদল বিক্ষুব্ধ শ্রমিক বিগবস কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন। পরে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন।

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে তাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তবে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের একটি গাড়িতে ভাঙচুর করলে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা চলে আসেন। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে, তারা সহযোগিতা করলে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা আবার গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার স্টোরকিপার ওয়াহেদ খান বলেন, বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিগবস কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় এসে হামলা ও ভাঙচুর চালান। পরে শ্রমিকরা তাদের কারখানার ওয়্যার হাউসে অগ্নিসংযোগ করেন। সেখানে মূল্যবান ফেব্রিক্স রয়েছে। এছাড়া এর আশপাশে বসতবাড়ি ও দোকানপাটও রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close