নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্রদের অবরোধে স্থবির রাজধানী
তেজগাঁওয়ে ৬ দফা দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ৭ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ * যানজটে ৩০ মিনিটের পথ চার ঘণ্টায়, যাত্রী ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি * হাতিরঝিল, মগবাজার, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মহাখালীতে সারা দিন যান চলাচল স্থবির, প্রভাব পড়ে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সাতরাস্তা এলাকায় ছয় দফা দাবিতে ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে গতকাল সোমবার সাত ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেছেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এতে ফার্মগেট থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে এফডিসির সামনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হাতিরঝিল র্যাম্পেও তীব্র যানজট দেখা যায়। এ ছাড়া হাতিরঝিল, রামপুরা, মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল ও মিন্টু রোড এলাকায়ও তীব্র যানজট দেখা দেয়। এসব এলাকায় শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্ত সব ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের কারিগরি অধিদপ্তর এবং সব প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। পাশাপাশি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদি এবং উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া অন্য কেউ আবেদন করতে পারবেন না এমন ছয় দফা দাবি তাদের।
বিক্ষোভকালে কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি আল ইমরান বলেন, আমরা যেহেতু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, আমাদের ইনস্ট্রাকটর পদে দশম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়া হোক। অথচ তারা (বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্ত সব ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর) টেকনিক্যাল বিষয় কিছু জানে না। তারা এ বিষয়ে শিক্ষিতই না। এসব ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের আমরা ইনস্টিটিউটে রাখতে পারি না।
আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি কেমিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। আমাদের যখন ল্যাব ক্লাস থাকে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের যিনি আছেন তিনি এ সম্পর্কে অবগতই নন। তিনি সালফিউরিক অ্যাসিড কখনো দেখেনই নাই, তিনি কীভাবে আমাকে বিক্রিয়া শেখাবেন?’
আরেক আন্দোলনকারী বলেন, ‘আমাদের তিন মাসে পাঠ্যক্রম শেষ করে। আমরা তিন মাসে কীভাবে ৮-৯টি বই শেষ করব? আমাদের দাবিগুলো যদি আগেই মেনে নেওয়া হতো তাহলে আমরা আজ রাজপথে আসতামই না। আমরা এসেছি কারণ আমাদের দাবিগুলো মানা হয় না। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছেও গিয়েছিলাম, তারা আমাদের গ্রাহ্য করেননি।’
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল বলেন, দাবি পূরণে সরকারের আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আমরা সড়ক ছাড়ব না। এদিকে সরেজমিনে ঘুরে সোয়া ১টার দিকে দেখা যায়, ফার্মগেট থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তা প্রায় পুরোটাই যানজটে স্থবির হয়ে ছিল। এ ছাড়া মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মগবাজার, ইস্কাটন, হাতিরঝিলের আশপাশের সড়কগুলোয় তীব্র যানজট দেখা যায়।
একজন বাস চালক বলেন, ‘আমরা দাবির কাছে আটকে গেছি। এই দাবি থেকে আমাদের কে যে মুক্ত করবে? একজনের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন আবার দাবির কাছে আটকে গিয়েছি। পুরো রাস্তাটাই জ্যাম। গাড়ি সব বন্ধ হয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থায় আছেন নারীরা।’ আরেকজন বলেন, ‘না খেয়ে বাচ্চাগুলো গাড়ির মধ্যে বসে আছে। এটাই হলো দেশের নিয়ম। হাজার হাজার মানুষ আটকে আছে, এটা দেখার কেউ নেই। তাদের দাবিটাই আগে।’
রাজধানীর বাসাবো থেকে তেজগাঁও আসছিলেন মো. শহীদুল্লাহ নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, ‘অন্যদিন অফিসে আসতে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে সর্বোচ্চ। আজ আসতে গিয়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেছে। মালিবাগ থেকেই যানজট দেখেছি। কোনো যানবাহন নড়ছিল না। তারপর রামপুরায়ও তীব্র যানজট। তেজগাঁও রেলক্রসিং এবং হাতিরঝিলের সামনে-সাতরাস্তাও বন্ধ ছিল। তীব্র রোদ এবং গরমের মধ্যে হেঁটেই অফিসে এসেছি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার তানিয়া সুলতানা বলেন, কারিগরি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বিজয় সরণি উড়ালসড়কে গাড়ি চলতে দেওয়া যায়নি। এ কারণে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এলাকায় যানজট হয়েছে। এফডিসি মোড়ে বেলা দেড়টার দিকে তীব্র যানজট হয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় মোটরসাইকেল নিয়ে থেমে ছিলেন মোহাম্মদপুর থেকে আসা হাতিরঝিল এলাকায় আসা মোটরসাইকেল আরোহী শফিক। তিনি বলেন, ‘অন্যদিন এখানে আসতে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে সর্বোচ্চ। আজ আসতে গিয়ে ২ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেছে। খামারবাড়ী থেকেই যানজট দেখেছি।
ডিএমপি তেজগাঁও জোনের সরকারি কমিশনার (ট্রাফিক) স্নেহ শীষ বলেন, শিক্ষার্থীদের হঠাৎ রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলনে এসব এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলা হলেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
কারিগরি শিক্ষার্থীদের ছয় দফা : ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্ত সব ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর কারিগরি অধিদপ্তর এবং সব প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতি সেমিস্টার (পর্ব) পূর্ণ মেয়াদের (ছয় মাস) করতে হবে। উপসহকারী প্রকৌশলী পদে (দশম গ্রেড) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ব্যতীত অন্য কেউ আবেদন করতে পারবেন না এবং উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমান পদ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে।
এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংস্কার করে কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত কোনো জনবল থাকতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিতর্কিত নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে সব শূন্য পদে কারিগরি জনবল নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষকসংকট দূর করতে হবে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য প্রস্তাবিত চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শতভাগ সিট নিশ্চিত করতে হবে।
"