গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিতর্কিতদের ঘেরাটোপ অন্তর্বর্তী সরকারে

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ ৮ সেপ্টেম্বর। বিতর্কিত আমলাতান্ত্রিক ঘেরাটোপের মারপ্যাঁচ থেকে এখনো সার্বিকভাবে বের হয়ে আসতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে ধীরলয়ে, অফিস-আদালতে কাজে ধীরগতি। দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত আমলাদের স্বল্পসময়ে তিন ধাপে পদোন্নতি দিলেও প্রত্যাশিত পদ, পদায়ন ও পদোন্নতি আংশিক পূরণ হয়েছে।

পদোন্নতি দিয়ে ১৩১ জনকে অতিরিক্ত সচিব করা হলেও তাদের ভেতর থেকে কাউকে সচিব করা হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কারের দৃশমান কাজের মধ্যে অবসরে যাওয়া বঞ্চিত ডজনখানেক আমলাকে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব করে চাকরিতে পুনর্বহাল করার কাজটি চোখে পড়ার মতো। এদিকে বিগত মাথাভারী আমলাতন্ত্র রয়েছে বহাল তবিয়তে। সুবিধাভোগী এ আমলারা সুযোগ বুঝে বাগিয়ে নিচ্ছেন লোভনীয় পদ। শেখ হাসিনার আমলের এসব আমলা প্রশাসনের সচিব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন এখনো। তাদের পছন্দের অনুজ প্রতিম কর্মকর্তাদের ভালো পোস্টিং দিতে আধাসরকারি পত্র (ডিও) এবং প্রধান উপদেষ্টাকে পরামর্শ দিচ্ছেন।

এর বাইরে গুটিকয়েক আমলাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি), দুয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং কিছু পদে চুক্তিতে থাকা পদ বাতিল করা হয়েছে। এটাকে দৃশ্যমান অগ্রগতি বলতে নারাজ অনেকে। তারা বলছেন, বেশিরভাগই অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা চক্রটি নেপথ্যে থেকে নাড়ছে কলকাটি। এ নিয়ে সংস্কারের পক্ষে থাকা কর্মকর্তাদের পক্ষটি মনস্তাপে পুড়ছে। এছাড়া ছাত্র আন্দোলনকে অকার্যকর করার দুয়েকজন বাদে অধিকাংশ জেলা প্রশাসকের ভূমিকা থাকলেও ২৫ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এখনো পদায়ন করা হয়নি পুরোমাত্রায়। নতুন ডিসি হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগীরা কৌশলে ভিড়ে যাচ্ছেন বর্তমান লোকপ্রশাসনে।

জানা গেছে, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সংস্কারের পক্ষে থাকা ছাত্র-জনতা সবাই চাইছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সময় দিতে। এতে খুশি হতে পারছেন না প্রশাসনযন্ত্রের চালিকাশক্তি দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত আমলারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত ১৫ বছরে ভিন্ন আদর্শিক তকমা লাগিয়ে অনেক আমলাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করেছে। এদের মধ্যে কাউকে ওএসডি, কাউকে করা হয় পদোন্নতি বঞ্চিত, কাউকে দেওয়া হয়েছিল শাস্তিমূলক ডাম্পিং পোস্টিং এবং অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর।

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতন হয়। ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি। ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। এরপর টানা ১৫ বছরে বঞ্চনার শিকার মানুষের ন্যায্যতা ফিরে পেতে সোচ্চার হয়। এর আগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের ‘ভয়ংকর’ ষড়যন্ত্রের তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে এ ষড়যন্ত্রের ছক করা হয়। পরিকল্পনা ছিল একটি ‘জুডিশিয়াল কু’র মাধ্যমে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা। কিন্তু আগেই এ ষড়যন্ত্রের তথ্য পেয়ে যান ছাত্ররা। এ বিচার বিভাগীয় কুর ষড়যন্ত্র কাজে আসেনি।

বিদায়ি সরকারের সাজানো প্রশাসনের তৎপরতা ও প্রশাসনিক অস্থিরতা কমিয়ে আনতে পদোন্নতি বঞ্চিত আমলাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান সরকার। সেখানেও পদে পদে নানা বাধা আসছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধতার পরও গত ১৩ আগস্ট প্রথম পদোন্নতি পান উপসচিব পদে। দুদিনের মাথায় ১৫ আগস্ট হয়ে যান যুগ্ম সচিব। এর তিন দিনের মাথায় ১৮ আগস্ট আরেকবার পদোন্নতি পেয়ে হন অতিরিক্ত সচিব। এ কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে যোগ্যদের সচিব করা এবং বাকিদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থায় পদায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু আজ অবধি নানা বাহনায় তাদের জনপ্রশাসনে সংযুক্তি রাখা হয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হলেও বেশিরভাগ কর্মহীন অবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসনের বিভিন্ন কক্ষে গল্পগুজব করে সময় পার করছেন।

গুরুতর অপরাধে জননিরাপত্তা সচিব জাহাংগীর আলমকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নৌ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল ও জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন আহমেদকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব সালাহউদ্দীন আহমেদকে ওএসডি করে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ চুক্তিতে থাকা ২৬ আমলার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। চুক্তিতে থাকা মন্ত্রপিরষদ সচিব মাহবুব হোসেন স্বপদে আছেন বহাল।

জানা গেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজে প্রধান উপদেষ্টাকে সহযোগিতা করছেন তার বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদার। আলী ইমাম মজুমদার ও তার ব্যক্তিগত সহকারী আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী গত স্বৈরাচারী প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকেই সরাতে চান না। আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী সর্বশেষ স্বৈরাচার হাসিনার সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস ও তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। দেশের আটটি জেলায় বন্যার সময় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করতে পারেননি আলী ইমাম মজুমদার। বিষয়টি জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে ছাত্র আন্দোলনের উদ্দেশ্য নস্যাৎ ও বিতর্কিত করার চক্রান্তে নেমেছে প্রশাসনের একদল আমলা। এই দলে সাবেক আমলারাও আছেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের একান্ত সচিব হয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ওই ব্যাচের সভাপতি ছিলেন। এর আগে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব ছিলেন। পরিবেশ বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের একান্ত সচিব আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন এ কর্মকর্তা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। এমন চিহ্নিত আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাকে উপদেষ্টার একান্ত সচিব নিয়োগ দেওয়ায় এখন সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জাহিদুল ইসলাম। আওয়ামী প্রশাসনের আস্থাভাজন হওয়ায় এ কর্মকর্তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক এসবির প্রধান মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানার ঘনিষ্ঠ এ কর্মকর্তা। নারায়ণগঞ্জের এডিসি এবং মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ইউএনও থাকা সময় তার বিরুদ্ধে আর্থিক ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ছিল। এরকম বিতর্কিত এক কর্মকর্তাকে একান্ত সচিব নিয়োগ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা। এছাড়া ছাত্র-জনতার ওপরে গুলি চালানোর কারিগর একসময়ের নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলমের একান্ত সচিব বর্তমান জননিরাপত্তা সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে বহাল আছেন। বিসিএস-৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা তিনি। এছাড়া বিমান বাংলাদেশের এমডি করা হয়েছে বোর্ডের সিদ্ধান্তে। এ পদটি প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব থেকে পদায়ন করার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। এ ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসে সীমিতসংখ্যক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও বিদায়ি সরকারের বেশিরভাগ সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব এখনো চাকরিতে আছেন। এ নিয়ে অন্তর্বর্ন্তী সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, আঞ্চলিক পরিচয়ে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে পড়েছেন সদ্য পতিত সরকারের কুশীলবরা। ফলে দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস আজ পূর্ণ হলেও প্রশাসনের সংস্কার কার্যক্রমে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাড়ছে বঞ্চিতদের হতাশা-ক্ষোভ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close