মেহেদী হাসান
কাস্টমস কর্মচারীর সম্পদের পাহাড়!
আশির দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি শুরু করেছিলেন মো. জালাল উদ্দিন। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় তার সর্বশেষ পদ ছিল কাস্টমস ইন্সপেক্টর (সিপাহি)। তথ্যমতে, একজন কাস্টমস সিপাহির মাসিক বেতন ৯ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই বেতনে চাকরি করে বর্তমানে জালাল অন্তত ৪০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকায় করেছেন ৬ তলা দুটি বাড়ি, গ্রামে কিনেছেন অন্তত ৩৮ বিঘা জমি। স্ত্রী, ছেলের বউ ও মেয়ের রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ। মেয়ের জামাইকে ব্যবসার জন্য দিয়েছেন টাকা। দুই ছেলের নামে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন ৫ কোটি টাকা।
প্রতিদিনের সংবাদের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের বর্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা মনসুর আলীর ছেলে মো. জালাল উদ্দিন। বর্তমানে ঢাকার খিলক্ষেত নামাপাড়া (বাঁশতলা) এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। মন্তাজবাগ রোডের ক-২০০/গ/১ নম্বর ৬ তলা হালকা সবুজ রঙের বাড়ির মালিক জালাল উদ্দিন। পাশের ঘ/১ নম্বর বাড়িটিও তার। এছাড়া বড় ছেলে রাজীবকে বড়ুয়া এলাকার ১১ তলা বাড়ি করে দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন জালাল। এছাড়া গ্রামের বাড়ি বারিষাব ইউনিয়নের ৬টি গ্রামে কিনেছেন অন্তত ৩৮ বিঘা জমি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কাস্টমসের সাবেক এ কর্মচারীর গ্রামের বাড়ি বারিষাব ইউপিতে বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। তথ্য বলছে, চাকরির শুরুতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ কাঠা। অথচ বর্তমানে তার জমির পরিমাণ ৪০ বিঘার ওপরে। নিজ গ্রাম বর্জাপুরে করিম প্রধানের ছেলে আবদুল বাতেনের কাছে থেকে কিনেছেন ৬২ কাঠা; আলাউদ্দিন মেম্বারের কাছে কিনেছেন ৩০ কাঠা; হামেদ আলী মুন্সীর মেয়ে হারেছা বানু, মরিয়ম বানু, আকিমুন নেসা, নূর বানু এবং আবদুল গফুরের দুই ছেলে হাসিমুদ্দিন ও হাফিজুদ্দিন তাদের বোন আনোয়ারা খাতুনের কাছে কিনেছেন ১০০ কাঠা চালা জমি। জালাল উদ্দিনের চাচা ইমামুদ্দিন ও মান্নানের কাছে কিনেছেন ৫০ কাঠা। ভিটারটেক গ্রামের বুরুজ আলীর কাছে ২৫ কাঠা; কুশদী গ্রামের সালামত পালোয়ানের ছেলে রাজ্জাক ও আজিজ পালোয়ানের কাছে ৪৫ কাঠা জমি কিনেছেন জালাল।
নিজ এলাকা ছাড়াও পাশের গ্রাম চরদুর্র্লভের বাসিন্দা নূরুল ইসলামের কাছে ২০ কাঠা; মামদি বাড়ির দুদু মিয়ার কাছে ১০ কাঠা; ইয়াকুব আলীর ছেলে আবদুল হাকির কাছে ১৬ কাঠা, করম আলী মৌলভীর ছেলে আবদুল বাতেন মৌলভীর কাছে ২৫ কাঠা; ভূঁইয়া বাড়ির ভূঁইয়ার কাছে ৩০ কাঠা; করম আলীর ছেলে হারিসের কাছে ২৫ কাঠা; আছর আলীর ছেলে রাজুর কাছে ৩০ কাঠা জমি কিনেছেন তিনি। জালারচর গ্রামের পল্লানের ছেলে আবদুল খালেকের কাছে ৬ কাঠা ও নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের ছফর উদ্দিন ঢালির কাছে ৬ কাঠা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। জালাল উদ্দিন প্রায় ৩৮ বিঘা জমি কেনার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এসব প্রশ্নে তার মত, তিনি দুর্নীতি বা অনিয়ম করে কোনো সম্পত্তি অর্জন করেননি।
জালাল উদ্দিনের মেয়ে জেরিনের স্বামী আবদুল মোমেনের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের সংবাদের। তিনি বলেন, ‘জালাল উদ্দিনের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে অন্যায় করে ফেলেছি? আপনারা তার সম্পত্তির কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন কেন? ঢাকার খিলক্ষেতে বাড়ি আছে, ছেলের নামে বাড়ি আছে- এটা সবাই জানে। তার এত সম্পত্তির খবর আমি নিজেই জানি না। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাকে নিউজের মধ্যে জড়াবেন না। আমি শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলি না আজ দেড় বছর। তার সঙ্গে কথা কিংবা দেখাও করি না।’ সূত্র জানায়, এই মোমেনের নামে গাজীপুর শহরে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন কোটি টাকা। এসব টাকার বেশিরভাগই দিয়েছেন তার শশুর জালাল উদ্দিন।
কথা হয় বারিষাব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম আতাউজ্জামান বাবলুর সঙ্গে। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘জালাল উদ্দিনকে চিনি। তার ছেলে রাজীব বেশ ভাব নিয়ে চলেন। এবার বুঝতে পারছি তার ছেলের কেন এত ভাব। কাস্টমসের কর্মকর্তা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। কিন্তু এত সম্পত্তির মালিক হয়েছে শুনে অবাক হলাম। ঢাকায় বাড়ি আছে জানি। তার ছেলে রাজীব বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে, কিন্তু ভাব দেখে এলাকার ছেলে মনে হয় না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খিলক্ষেত নামাপাড়া (আমতলা) এলাকার এক স্থায়ী বাসিন্দা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘জালাল সাহেবকে আমি ৩০ বছর ধরে চিনি। আমাকে চাকরির জন্য অফার করেছিলেন। কিন্তু ঘুষ দিয়ে চাকরি নেব না বলে নিইনি। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি জালাল সাহেবের। ছেলেকে ১১ তলা একটা বাড়ি করে দিয়েছেন। ৩ বাড়ি থেকে কমপক্ষে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা ভাড়া তোলেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘জালালের আরেক ভাই একই পদে চাকরি করে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকা শহরে থাকতে পারেননি। ঘুষ না খাওয়ায় মগবাজারে ভাড়া বাসায় থেকে জীবন পার করেছেন। অথচ ঘুষ-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন জালাল। এখন বয়সের চাপে লাঠি নিয়ে চলেন, অসুস্থ।’
গত ১৩ জুলাই খিলক্ষেত নামাপাড়ার নিজ বাড়িতে সাক্ষাৎ হয় জালাল উদ্দিনের সঙ্গে। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী, কীভাবে এত সম্পদের মালিক হতে পারেন- এমন প্রশ্নে জালাল উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আপনি যেসব সম্পত্তির কথা বলছেন, এসব জমি আমার। এছাড়া ৬-৭ (এক কানি ১.২ বিঘা) কানি জমি আছে। এ বাড়িটা আমার, পাশের বাড়িও আমার। ছেলে ওই বাড়িতেই থাকে। আমি ব্যবসা করে এগুলো সম্পত্তি করেছি। আমি ঘুষ-দুর্নীতি করে এসব করিনি। শেয়ারবাজারে টাকা লাগিয়েছি, কারণ ছেলেরা বেকার থেকে কী করবে?’ তবে জালাল উদ্দিনের কোনো ব্যবসা ছিল না বলে জানিয়েছেন তার চাচা বুরুজ আলী। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘জালালের টাকার উৎস কোথায়, তা আমরা আজও ধরতে পারিনি। তেমন জমিজমাও ছিল না। ব্যবসা ছিল না। অবৈধভাবে টাকা আয় করা ছাড়া এত টাকার মালিক হতে পারা সম্ভব নয়। প্রচুর পরিমাণে জমি কিনেছে জালাল। আমিও ২৫ কাঠা বিক্রি করেছি তার কাছে। সম্পদের দিকে দেখে আমরা মনে করতাম বড় কর্মকর্তা। আমরা তো ওত বুঝি না।’ আপনার চাচা বুরুজ আলী বলেছেন, ‘ব্যবসা ছিল না’, মিথ্যা বললেন কেন? এর উত্তরে জালাল উদ্দিন তার ব্যবসার ব্যাপারে উত্তর দিতে পারেননি।
"