প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
শহীদি মার্চে জনতার ঢল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ‘শহীদি মার্চ’ পদযাত্রায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সর্বস্তরের জনতার ঢল নামে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে এ পদযাত্রা শুরু হয়।
‘শহীদি মার্চ’ থেকে ৫টি দাবি জানানো হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। দাবিগুলো হলো- ১. গণহত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২. শহীদ পরিবারগুলোকে আর্থিক ও আইনি সহযোগিতা দ্রুত সময়ের মধ্যে দিতে হবে। ৩. প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ৪. গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর ঘোষণা করতে হবে। ৫. রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণা করতে হবে।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পদযাত্রাটি নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কলাবাগান, মিরপুর রোড ধরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ ও রাজু ভাস্কর্য হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুরূপ ‘শহীদি মার্চ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ২টা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদি মার্চ কর্মসূচিতে অংশ নিতে দলে দলে ছাত্র-জনতা জড়ো হতে থাকেন। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আসতে থাকেন স্কুলড্রেস পরেই। তাদের বেশিরভাগের হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। দুপুর আড়াইটার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করে। পৌনে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্য থেকে মার্চ শুরু হয়।
এ সময় তারা ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘শহীদদের স্মরণে, ভয় করি না মরণে’, ‘শহীদদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন ভারতে’, ‘সরকার কী করে, হাসিনা ভারতে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারও শিক্ষার্থীর সঙ্গে এই মার্চে যোগ দেয় সর্বস্তরের মানুষ। আশপাশের দোকানিরা হাত নাড়িয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজনে শহীদি মার্চের পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পূর্ণ হওয়ায় শহীদদের স্মরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহীদি মার্চের পদযাত্রা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের টেংকেরপাড় মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শহীদি মার্চে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। পদযাত্রা শেষে এক সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষার্থী আল মামুন, দুর্জয় মাহমুদ, রেহেনা বুশরা, মুনিয়া, রিয়াদুল ইসলাম, আবু বাশার সানি, গাজী মো. নিয়াজুল করিম প্রমুখ। বক্তারা ছাত্র আন্দোলনে সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারও তার বাহিনী ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে। দেশে যারাই সরকার গঠন করুক এসব ঘটনার দ্রুত বিচার করতে হবে, অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। বক্তারা আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে মাঠে নেমেছে। তাই সব অপপ্রচার থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শেরপুর : গতকাল দুপুরে জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজনে শেরপুর সরকারি কলেজের সামনে থেকে শহীদি মার্চ শুরু হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে চকবাজারের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন শেরপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুর রশীদ, জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সঞ্জয় বণিক, শেরপুর সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ শাহ কামাল হোসেন আকন্দ, কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিবশঙ্কর কারুয়া শিবু, জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোর্শেদ জিতু, ফারহান ফুয়াদ তুহিন, লিপু, মনি, চৈতী, সোহান, তৌহিদুর রহমান, আশরাফুল, সজীব প্রমুখ।
মেলান্দহ (জামালপুর) : জামালপুরের মেলান্দহে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দুপুরে উপজেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আয়োজনে শহীদি মার্চের পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন, জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাশরাফি, মেলান্দহ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মো. সোয়েব আহমেদ, মোহাম্মদ আসিফ, মোহাম্মদ পনির আহমেদ প্রমুখ। পদযাত্রাটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে মেলান্দহ অডিটোরিয়ামে এসে শেষ হয়। সেখানে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক মানুষ অংশ নেন।
দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা) : ঢাকার দোহারে শহীদি মার্চ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। দুপুর ১২টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দোহার শাখার আয়োজনে জয়পাড়া কলেজ থেকে শহীদি মার্চের পদযাত্রা শুরু হয়। মিছিলটি উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে থানার মোড় ঘুরে করম আলী মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। পরে পথসভায় বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এ সময় হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তারা। এছাড়া আন্দোলনে যারা আহত রয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার দাবি জানান।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৩টায় উপজেলার কলেজ মোড় থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শহীদি মার্চের পদযাত্রা উপজেলা পরিষদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সব শহীদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দেন। পরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করে কর্মসূচি শেষ করেন।
বেরোবি : রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) শহীদি মার্চের পদযাত্রা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পাদদেশ থেকে পদযাত্রাটি শুরু হয়ে মডার্ন গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারকে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে শেষ হয়। এ সময় বক্তব্য দেন আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদের হত্যার তদন্ত করে দায়ীদের ফাঁসি চাই। আবু সাঈদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলের নামকরণের দাবি জানান তিনি।’ আবু সাঈদের বড় ভাই বলেন, আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘সাঈদ ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, শহীদের চেতনা, ভুলি নাই ভুলব না’- এ সময় এসব স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা।
হাতিয়া (নোয়াখালী) : গতকাল বিকেল ৪টায় দ্বীপ হাতিয়ার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে শহীদি মার্চের পদযাত্রা ও সমাবেশ হয়েছে। হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত ছাত্র-জনতা সেখানে যোগ দেন। হাতিয়া উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ছাত্র-জনতার ওই শহীদি মার্চ উপজেলা শহরের প্রধান সড়ক হয়ে ওছখালী পুরোনোবাজার প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। শহীদ মিনারের সমাবেশে মতিউর রহমান মোকাররমের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাইফুল ইসলাম, তামজিদ উদ্দিন প্রমুখ। বক্তারা বলেন, হাতিয়া বিগত সরকারের আমলে সেসব সমস্যা সমাধান করা হয়নি, আমরা তা সমাধান করে তার সুফল পেতে শুরু করেছি। এরই মধ্যে হাতিয়ার মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা নলচিরা চেয়ারম্যানঘাট নৌরুটে ও ঢাকার লঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ সেবা উন্নত করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকদের অনিয়ম ও সরকারি দপ্তরগুলো নানা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে এরই মধ্যে সংস্কার কল্পে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাতিয়ায় কোনো সন্ত্রাসীদের উৎপাত আর মাথাচাড়া করতে দেওয়া যাবে না। সম্প্রতি হাতিয়ায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়- যাতে নিরীহ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যমূলক হয়রানি করা না হয়।
"