কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ধসে পড়ছে এস আলমের সাম্রাজ্য

১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্তে সিআইডি

ধসে পড়েছে দেশের বহুল আলোচিত এস আলমের সা¤্রাজ্য। একে একে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। এস আলমের পরিবার থেকে শুরু করে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরাও এখন সন্দেহের তালিকায়। এস আলমের নগদ টাকা খুঁজতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কয়েকটি টিম মাঠে তৎপর। সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত করে দেশ থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। বিদেশে এস আলমের কী পরিমাণ টাকা রয়েছে তা জানার জন্য বিভিন্ন দেশেও সরকার তদন্ত করছে। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অনুসন্ধান বলছে, দেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে এস আলম গ্রুপ হস্তক্ষেপ করেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নামে-বেনামে রয়েছে এস আলমের বিপুল ভূসম্পত্তি। নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ। অভিযোগ রয়েছে, এস আলম বেশকিছু সাধারণ মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েও শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে নিজেদের জন্য। এস আলম ঘনিষ্ঠদের মধ্যে সাংবাদিক থেকে শুরু বিভিন্ন পর্যায়ের লোক রয়েছে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এস আলমের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। এ কথা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত যে, এস আলম যা করেছে তা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ছায়ায় থেকে করেছে। এ কাজটি দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এস আলম দেশের টাকা বাইরে সরিয়ে নিয়ে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করার কাজে লিপ্ত ছিল। ঠিক কী পরিমাণ টাকা এস আলম সরিয়েছে, তা বের করতে আরো দীর্ঘ তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এস আলমের দুই ডজন কোম্পানির অস্তিত্ব রয়েছে। যাতে মোট সম্পদের মূল্য প্রায় ১.৫ লাখ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আর্থিক মূল্য দেখানো হয়েছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড প্রপার্টিজ খাতে। যার আর্থিক মূল্য দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ২৮ ইউনিট জমি ও ভবন ঢাকা এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত। এস আলমের কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যার মূল্য ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। আমদানি রপ্তানি, চিনি, সিমেন্ট খাতসহ বিভিন্ন খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং ৭টি ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক খাতে ৪ হাজার কোটি দেখানো আছে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এটা অতিরঞ্জিত।

এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এস আলমের হাতছাড়া হয়েছে। বিশেষ করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকটি নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছিল গ্রাহকদের মধ্যে। এস আলমের এ ব্যাংকটি ঘিরে গুজবের শেষ নেই। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পর্ষদে রাখা হয়নি এস আলম বা তার আগের কোনো শেয়ারহোল্ডার পরিচালককে। পুরোনো পর্ষদ ভেঙে সেখানে ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দুঃসম্পর্কীয় ফুফাতো ভাই আনছারুল আলম চৌধুরীকে আটক করা হয়েছে। ?দুবাই পালিয়ে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে তাকে আটক করা হয়। বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক তার কাছ থেকে ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা পাবে।

এস আলমের বিরুদ্ধে সার্বিক তদন্ত শুরু করেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে সিআইডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, এস আলম গ্রুপের মালিক এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধ, প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। এস আলমসহ তার সহযোগী ব্যক্তিরা ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারে জড়িত সন্দেহে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সিআইডি আরো উল্লেখ করেছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে এস আলমসহ সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে এক দিনের ব্যবধানে আবার বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের (পিআর) অনুমতি গ্রহণ করেছেন। তারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস ও ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে নিজের ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ করেছেন। সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এস আলমের পাচার করা অর্থে সিঙ্গাপুরে ২ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিরা। তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগের নামে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে এস আলম অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আনা হয়েছে। সিআইডি বলছে, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলমসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং অপরাধ করেছেন তারা।

এদিকে এস আলম গ্রু?প ও তাদের স্বার্থসং?শ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংকের লেন?দেন, ঋণ স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন প্রতিষ্ঠান?টি নামে-বেনামে থাকা বি?ভিন্ন জ?মি-সম্পদ বি?ক্রি করার চেষ্টা করছে। এগুলো ঠেকাতে আইনি প্রক্রিয়া দরকার। তাই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এ মুহূর্তে এস আলম গ্রুপের জ?মি ও সম্পদ না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে গোপনে সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে এস আলম গ্রুপ। আইনি জটিলতার কারণে এখনি হস্তক্ষেপ করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শিগগিরই আইনি উপায় খুঁজে বের করা হবে। তাই সর্বসাধারণকে সাবধান করা হচ্ছে এস আলম গ্রুপের সম্পদ কেউ কিনবেন না। সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমি হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি। এসব সম্পদ জনগণের। এখানে কেউ হাত দেবেন না।’

বিএফআইইউর কর্মকর্তারা জানান, এস আলম গ্রুপ ব্যাংক খাত থেকে মোট কত টাকা ঋণ হিসেবে বের করেছে, সেটি বের করতেই ব্যাংক হিসাব ও ঋণ হিসাবের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী ১৮ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব ও ঋণ হিসাবের তথ্যও জানতে চেয়েছে বিএফআইইউ। তারা হলেন প্রশান্ত কুমার দাস, মো. হেলাল, বদিউর রহমান, আবদুল করিম, সৈয়দ আলম, মো. হাছান, নুরুল আলম, আবদুল কুদ্দুস, দিল মোহাম্মদ, আলী আহম্মেদ, মো. সাকের মিয়া, আলমগীর ফয়সাল, জাহাঙ্গীর আলম, সামছুল আলম, মো. ইউনুছ, নুরুল আফসার, মো. শাহজাহান আনছারী।

এরই মধ্যে এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এজন্য একটি তদন্ত দল গঠন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। গত জুন মাসে এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পান ভ্যাট কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো চট্টগ্রামের এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড। এস আলম পরিবারের সদস্যসহ ২৫ ব্যক্তি ও ৫৬ প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা ৬ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. সাইফুল আলম মূলত এস আলম নামেই বেশি পরিচিত। তিনি বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, তার পক্ষে পরিবারের সদস্যরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অপরাধ করেছিলেন। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই গত সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে দেশের ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমাসহ নানা খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সূত্র মতে, এস আলম পরিবারের মালিকানায় রয়েছে ৫৬টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে ছয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এবং ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তার ছেলে আহসানুল আলম। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর একে একে প্রতিষ্ঠানগুলো এস আলম মুক্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে সরকার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close