মো. জাহিদুল ইসলাম
পাকিস্তান হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশের ইতিহাস
লাল-সবুজের বিজয় নিশান উড়ল পাকিস্তানের মাটিতে। ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, এ সিরিজ জয় এলো পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে হারিয়ে। ব্যর্থতা ও হতাশার অনেক প্রহর পেরিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই পেরেছে বিজয় নিশান ছড়িয়ে দিতে- পাকিস্তানে যেমন, তেমনি ক্রিকেট বিশ্বেও।
দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর তৃতীয় দিনে ব্যাট হাতে যখন ২৪ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে বসেছিল বাংলাদেশ, তখন জয়কে মনে হচ্ছিল দূর আকাশের তারা। ততক্ষণে প্রথম টেস্ট জয়ের আনন্দ ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কায় লজ্জা চেপে বসেছিল লাল-সবুজ শিবিরে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কাকে দূরে ঠেলে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে শান্তবাহিনী জয়টা পেল দাপটের সঙ্গেই। দ্বিতীয় টেস্টে পাকিস্তানকে ৬ উইকেট হারিয়ে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জয়ে নিজেদের রাঙাল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। মাঠ থেকে ড্রেসিংরুম হয়ে পুরো মাঠে, রাওয়ালপিন্ডি হয়ে গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ল যেন সেই আওয়াজ। পাকিস্তানের বুকে বাংলাদেশের বিজয় উল্লাস!
এই প্রথমবার কোনো পূর্ণ শক্তির দলের বিপক্ষে দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ। বিদেশে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র সিরিজ জয়টি এসেছে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের ঝামেলায় সেবার দ্বিতীয় সারির দল খেলায় ক্যারিবিয়ানরা। ফলে টেস্টে এখন পর্যন্ত এটাই বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। শেষ ইনিংসের ১৮৫ রান তাড়ায় শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৪৩ রান। সেই লক্ষ্যে খুব দ্রুততায় ছুটতে পারেনি দল। তবে প্রয়োজনও পড়েনি। ম্যাচ সবসময়ই ছিল নিয়ন্ত্রণেই। রান তাড়ায় কখনো মনে হয়নি বাংলাদেশ হারতে পারে।
ফিফটি করতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান। কয়েকজনের অবদানে বেশ সহজেই জিতে গেছে বাংলাদেশ। গোটা সিরিজেরই প্রতীকী বলা যায় এ শেষ ইনিংস। সম্মিলিত দলীয় পারফরম্যান্সের জয়গান গেয়েই অসাধারণ এ সিরিজ জয়ের সাফল্য ধরা দিয়েছে। নিজেদের সুদীর্ঘ টেস্ট ইতিহাসে আগে শুধু একবারই দেশের মাঠে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল পাকিস্তান। ২০২২ সালে তারা তিন ম্যাচের সিরিজের সবক’টি হেরেছিল ইংল্যান্ডের কাছে। এদিনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের জয়টাই ছিল সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল। কিন্তু ম্যাচের তৃতীয় দিনে (কার্যত যা ছিল দ্বিতীয় দিন) ফিরে গেলে, ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছিল বাংলাদেশ, মান বাঁচানোই যখন মনে হচ্ছিল বড় দায়, সেখান থেকে এভাবে ম্যাচ জয় তো রূপকথার মতোই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে এ জয়।
প্রথম ইনিংসে এত কম রানে ৬ উইকেট হারিয়েও জয় টেস্ট ক্রিকেটে দেখা গেল ১৩৭ বছর পর! সেই ১৮৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ও পরে ৪৫ রানে অলআউট হয়েও শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। এবার বাংলাদেশও এ রেকর্ডে তাদের সঙ্গী। দিনের শুরুতে পাকিস্তানি পেসারদের বোলিং ছিল বেশ আঁটসাঁট। দ্বিতীয় বলে সাদমান ইসলাম একটি চার মারলেও পরে শট খেলার সুযোগ খুব একটা পাননি দুই ব্যাটসম্যান। সকাল থেকে দারুণ বোলিং করতে থাকা মির হামজা পাকিস্তানকে এনে দেন প্রথম সাফল্য। তার দুর্দান্ত ডেলিভারি জাকির হাসানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে ছোবল দেয় স্ট্যাম্পে। আগের দিন ২৩ বলে ৩১ রান করা ওপেনার আউট হন ৩৯ বলে ৪০ রান করে।
একটু পর হামজার বলেই রক্ষা পান সাদমান। স্লিপে কঠিন ক্যাচ তালুবন্দি করতে পারেননি সালমান আলী আগা। তবে পরের ওভারেই ফাঁদে পা দেন এ ওপেনার। বারবার তাকে ড্রাইভ করতে প্রলুব্ধ করছিলেন পাকিস্তানি বোলাররা। ড্রাইভ খেলেই মিডঅফে সহজ ক্যাচ দেন তিনি ২৪ রান করে। এরপর কিছুটা অস্বস্তিময় সময় এসেছে নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুমিনুল হকের জন্য। ব্যাটের কানায় লেগেছে বল, স্লিপ দিয়ে গলে গেছে কয়েক দফায়। তবে সব সামলে রানও বাড়াতে থাকেন দুজন। লাঞ্চের আগে জুটি পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ। লাঞ্চের পরপর শান্তকে হারায় বাংলাদেশ। সালমানকে রিভার্স সুইপে চার মারার পরের বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক (৮২ বলে ৩৮)। টানা ৯ ইনিংসে ফিফটির দেখা পেলেন না তিনি। এর চেয়েও বড় আক্ষেপ হতে পারে এদিন, জয়ের মুহূর্তটায় থাকতে পারলেন না ক্রিজে।
সেই সুযোগটি হারান মুমিনুলও। দীর্ঘক্ষণ লড়াই করে এক প্রান্ত থেকে দলকে টানছিলেন তিনি। ব্যাট করছিলেন বেশ সতর্কতায়। কিন্তু হঠাৎ আবরার আহমেদকে তুলে মেরে উইকেট হারান তিনি ৩৪ রানে (৭১ বলে)। মুশফিকু রহিম ও সাকিব আল হাসান সেই ভুল করেননি। দলের অভিজ্ঞতম দুই ক্রিকেটার আস্তে আস্তে দলকে নিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। জয় নাগালে থাকার পরও অনেক সময় নিয়েছেন দুজন। ৩২ রান এসেছে শেষ ১২ ওভারের অবিচ্ছিন্ন জুটির হাত ধরে। আর তাতেই ধরা দিয়েছে লাল-সবুজের বিজয়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
পাকিস্তান প্রথম ইনিংস : ২৭৪
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ২৬২
পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংস : ১৭২
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : ১৮৫/৪
ফল : বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী
সিরিজ : ২ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ
২-০ ব্যবধানে জয়ী
ম্যাচসেরা : লিটন কুমার দাস
সিরিজসেরা : মেহেদী হাসান মিরাজ
"