নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

অর্থনীতিতে সংস্কার শুরু

গত ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এমন উন্নয়নে যে ব্যয় দেখানো হয়েছিল, তার বেশিরভাগই হয়েছে আত্মসাৎ ও পাচার। ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে ঋণের বোঝা; অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল হয়েছে সাধারণ মানুষ। এমন অবস্থায় অর্থনীতি সংস্কারে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে মূল্যস্ফীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। দেশের অর্থনীতি কতটা উন্নত, তা নির্ভর করে জীবনযাত্রার মান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর। যেখানে অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণে থাকে মূল্যস্ফীতি।

দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি আগস্টে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট শুরু হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি আর্থিক খাত সংস্কারের ঘোষণা দেন। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান জোরালোভাবে কাজ শুরু করেছেন। এ অবস্থায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে নীতিগত সংস্কারের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে অনেক কাজ (সংস্কার) শুরুও হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান সরকার যেভাবে দেশের আর্থিক খাত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তা ইতিবাচক। কাজ করতে পারলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়তে সময় লাগবে না। শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল, তা কাটাতেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

এদিকে সরকার পতনে পর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার প্রথম পদত্যাগ করেন। নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। নতুন গভর্নর এরই মধ্যে ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ইসলামী ব্যাংকে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ডুবতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদের নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে আমানতকারীদের আস্থা ফিরছে।

জানা যায়, গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত জুলাই মাসে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাসটিতে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, মূল্যস্ফীতিও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে। এতদিন ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। বিবিএসের হিসাবে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৬৬ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী দিনে সুদের হার ৯ শতাংশে উন্নীত করবে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আগামী দিনে সুদের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে উন্নীত করা হবে বলে জানায়। কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মূল্যস্ফীতি তীব্র বৃদ্ধির পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সব শঙ্কা কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পোশাক খাত : অবশ্য গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে পঙ্গু করা হয়েছে, তা স্বল্পসময়েই পুরোটা সংস্কার করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তবে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তা অনেকটাই পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে সবার আগে প্রাধান্য দিয়ে কমানোর কথা বলা হয়েছে। কারণ অর্থনীতির যদি ক্ষতি হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি চাপে থাকেন সাধারণ মানুষ। আর গত দেড় যুগে উন্নয়নের যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা শোনানো হয়েছে; অন্যদিকে রূপান্তর করা হয়েছে তলাবিহীন ঝুড়িতে।

তথ্যমতে, আর্থিক খাতে যে সংস্কার করা হবে তার মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ এবং ঘাটতি বাজেট অর্থায়ন বিষয়াদি থাকবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎপাদন, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ। আর বাহ্যিক ভারসাম্যের মধ্যে থাকবে রপ্তানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়নের প্রভাব ও ঋণ। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে মন্দ ঋণ ও পাচার হওয়া অর্থ এবং ব্যাংক খাত সংস্কারে কাজ চলমান রয়েছে। আর বিগত বছরগুলোয় রপ্তানির বিপরীতে আমদানির যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এতে ডলার সংকটের সঙ্গে তলানিতে নেমে এসেছে রিজার্ভ। তাই সংস্কারের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করা, সরকারি ব্যয়ে কমানো ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ করার প্রতিও নজর দেওয়ার কথা জানান বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের এখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং গুণগতমান উন্নত করতে হবে। এটা করা গেলে আমাদের অর্থনীতি সাম্প্রতিকালে যে চাপের মধ্যে পড়েছে, সেটা মূল্যস্ফীতির চাপ হোক আর ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপির চাপ হোক, আমাদের যে রাজস্ব আহরণ আমরা করতে পারছি না, সেটার কারণে আমাদের যে একটা ঋণনির্ভরতা হয়ে আছে। যেটা অনেক বিপজ্জনক এবং বাধ্যতামূলক। সেটার নিরসন হবে। সে সব জায়গায় আমাদের সুশাসন দরকার হবে। অন্যদিকে সামগ্রিক অস্থিতিশীলতাকে অর্থনীতির বিষফোড়া বললেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের অপশাসন ও অবহেলার কারণে যে অবকাঠামো সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার কথা জানান তিনি।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে যেটা অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা হলো সামষ্টিক অস্থিতিশীলতা। অতি দ্রুত আমাদের যে সমস্যা দীর্ঘদিনের অবহেলা বা অপশাসনের কারণে তৈরি হয়েছে, সেখানে কী ধরনের সংস্কার করা হবে তা করতে হবে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য ও সেবার ব্যবহার বেড়েছে ৩.৫৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ২.৫২ শতাংশ। অবশ্য করোনা মহামারিতে ২০১৯-২০ অর্থবছর ভোগ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৯ শতাংশ। ওই সময় বাদ দিলে অন্তত ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে এ প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। এদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। ফলে দেশের মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে।

রাজধানীর পল্লবীতে বসবাস করেন আলী আসগর ইসলাম বাবু। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তার পরিবার ৩০ শতাংশ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে। সবকিছুর খরচ বাড়লেও তার সঙ্গে মিলিয়ে আমার বেতন বাড়েনি।’ এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এ পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই ভোগের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। গত দুই বছর ধরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির গতিতে বাড়ছে না। বরং প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির ছিল ৯.০২ শতাংশ, যা গত কয়েক বছরের গড় ৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ভোক্তা মূল্য সূচক প্রায় ৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। একই বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ভোক্তা মূল্যবৃদ্ধির কারণে বহু মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। যেহেতু মজুরি এবং আয় প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়েনি, তাই মানুষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তারা শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ জোগাতে ভোগ, সঞ্চয় এবং অন্যান্য ব্যয় কমিয়েছেন। করোনা মহামারিতেও একই অবস্থা দেখা গিয়েছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close