মেহেদী হাসান

  ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইলিশে গুড়েবালি সিন্ডিকেট-মজুদ

মৌসুম চলছে ইলিশের। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতে ইলিশ ‘উপহার’ ও রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ফলে দেশের বাজারে ইলিশের জোগান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমার আশায় ছিল দেশের মানুষ। সে আশায় এখন গুড়েবালি। স্বল্প আয়ের মানুষ ইলিশের ধারে কাছেও যেতে পাচ্ছেন না। আড়তে আসা প্রায় সব ইলিশই যাচ্ছে ফ্রিজিং করে মজুদদারদের ঠাণ্ডা গুদামে। এর সঙ্গে সক্রিয় আছে চরম মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

ভেবেছিল কম দামে এবার যদি পাতে এক টুকরো রুপালি মাছ জোটে! কিন্তু না, কমার বদলে উল্টো দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর কারণ হিসেবে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যাবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক বলেছেন, ডিজেলের উচ্চ মূল্য এবং সিন্ডিকেট। ইলিশের দাম কী হবে তা সকালে নির্ধারণ করে দেয় মোকামের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বিক্রি না হলে ফ্রিজিং করে রাখে। পাশাপাশি দাদন টাকা আরেকটি কারণ। দাদনদাতারা জেলেদের কাছ থেকে ১০ ভাগ মুনাফা নেন। দাদনদাতা মহাজনের আড়তেই মাছ দিতে হয়। এই তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ইলিশের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ৩০০ টাকা কমে যাবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বেশির কারণ সিন্ডিকেট নয়, ধরা পড়ছে কম। ভরা মৌসুমেও ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুরেই দেখা নেই ইলিশের।

রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রেতা মাছ কেনার আশা নিয়ে বাজারে আসছেন ঠিকই কিন্তু দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। গতকাল ঢাকার কারওয়ানবাজার, কাজীপাড়া, মিরপুরের ৩টি বাজার ঘুরে সরেজমিনে এ চিত্র দেখা গেছে। কারওয়ানবাজারের মাছ বিক্রেতা হাসান আলী বলেন, হিমাগারের ইলিশের দাম কেজি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। বাজারে টাটকা ইলিশ সেভাবে পাবেন না। যদি সে রকম টাটকা ইলিশ খেতে চান তাহলে চাঁদপুরের মোহনাতে যান।

পশ্চিম কাজীপাড়া মাছ ব্যবসায়ী আবদুল হালিম বলেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ হলেও দেশে দাম কমেনি। আমরা বেশি দামে কিনেছি। কম দামে কীভাবে বিক্রি করব। কাজীপাড়ার এই দোকানে ৫০০ গ্রাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজিতে। ৬০০ থেকে ৬৫০ গ্রামের ইলিশ ২ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজির ওপরে ইলিশ ২ হাজার ৭০০ টাকা কেজি। এখন বড়লোক ছাড়া ইলিশ কিনতে পারে না। গরিবরা দাম শুনতেও আসে না।

বরিশালে বাড়ছে ইলিশের দাম : বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ বাজারের ফাহিম মৎস্য আড়তের প্রোপাইটার ফোরকান মিয়া জানান, গত চার দিন ধরে অভ্যন্তরীণ নদীতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না। অন্যদিকে সমুদ্রে ধরা পড়া মাছ বরিশালের বাজারে এখনো আসেনি। যার দরুন প্রতি কেজি ইলিশ মাছের দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বেড়েছে। সামনে পূর্ণিমার জো। এ সময় আবারও মাছ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন থেকে আবার দাম হয়তো কমতে পারে।

পোর্ট রোডের আড়তদার মো. রানা জানান, বন্যা ও বৃষ্টির সময় নগরীর পোর্ট রোড মোকামে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মন ইলিশ মাছ বেচা কেনা হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে ১০০ থেকে ১৫০ মণের বেশি মাছ বাজারে উঠে না। যার কারনে দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি জানান, বর্তমানে নদীতে একটু মাছ কম। সমুদ্রের ইলিশও আসে না। তাই দাম একটু বেশি। তবে কেউ অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে, এমন কোনো তথ্য নেই।

ইলিশের আকাল চট্টগ্রামের বাজারে : ভরা মৌসুমেও চট্টগ্রামের বাজারে ইলিশের আকাল চলছে। আশানুরূপ সরবরাহ না থাকায় দামও আকাশচুম্বী। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে গত ২৩ জুলাই সাগরে ইলিশের জন্য বেপরোয়া জেলেরা। তবে মিলছে না ইলিশ। যা মিলছে তা দিয়ে স্থানীয় চাহিদাও মিটছে না।

সূত্র মতে, গত ২৪ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে মাছ আহরণের পরিমাণ ৩০০ টনের মতো। জেলেদের মতে, ইলিশের দেখা না মেলায় পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝা। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুর্দশায় জেলেদের দিন ভালো যাচ্ছে না।

গতকাল সোমবার চট্টগ্রামে সামুদ্রিক মাছের বৃহৎ পাইকারি বাজার নগরের নতুন ফিশারীঘাটে দেখা যায় তুলনামূলকভাবে কম ইলিশ। ভোর থেকেই হাঁকডাকে জমে ওঠলেও বেচাকেনা তেমন হচ্ছে না। ক্রেতা বিক্রেতার দরকষাকষি। দাম বেশি অভিযোগ ক্রেতার।

আনোয়ারার জেলে মফিজ মিয়া বলেন, ভরা মৌসুমেও মিলছে না ইলিশ। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার দুই জোর মধ্যে ১০ ভাগের এক ভাগ মাছ বোটে তোলা সম্ভব হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যায়। আমরা পাচ্ছি না।

সরবরাহ কম থাকায় ভরা মৌসুমেও নাগালের বাইরে ইলিশের দাম। নগরের চৌমুহনী বাজারে ৭৫০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম আকারের ইলিশ ২ হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে, ৬০০ গ্রাম থেকে ৮০০ গ্রাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে এবং ছোট আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৭০ টাকা দরে।

ইলিশের বাড়িতেই চড়া দাম : চাঁদপুরে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। মোহনায় ধরা ইলিশ নিয়ে নৌকাণ্ডট্রলার অনবরত ঘাটে ভিড়ছে। তবুও কম দামে মিলছে না ইলিশ।

চাঁদপুর বড় স্টেশন ফিশারীঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, ১ কেজি ওজনের বেশি ইলিশের কেজি ১৮০০ টাকা। দেড় কেজি ওজনের বেশি ইলিশ ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা কেজি। এখানেই দাম বেশি। ঢাকায় যে ইলিশ আপনারা খেয়ে থাকেন সেই ইলিশ আসলে চাঁদপুরের ইলিশ নয়। দাম বেশির কারণ সিন্ডিকেট নয় বরং ইলিশ কম ধরা পড়ছে। বাজারে মাছের সংকট, চাহিদা বেশি। এই ভরা মৌসুমে এখানে মাছ রাখার জায়গা পেতাম না কিন্তু এখন নিজেই দেখছেন মাছের কেমন আমদানি।

ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব?্যবস্থাপনা প্রকল্পের প?রিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, ডিজেলের উচ্চ মূল্য ইলিশের দাম না কমার অন?্যতম কারণ। আরেকটি কারণ হলো সি?ন্ডি?কেট। ইলি?শের দাম কী হ?বে তা সকা?লে নির্ধারণ ক?রে দেয় মোকা?মের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বিক্রি না হলে ফ্রিজিং করে রাখে। পাশাপাশি দাদনও আরেকটি কারণ। দাদনদাতারা জে?লেদের কাছ থে?কে ১০ ভাগ মুনাফা নেন। দাদন নি?য়ে ওই মহাজনের আড়?তেই মাছ দি?তে হ?বে। এই মুনাফা ৫ শতাংশে নামা?তে হ?বে। এই তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা গে?লে ইলি?শের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ৩০০ টাকা ক?মে যা?বে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বরিশাল, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর প্রতিনিধি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close