মিজান রহমান

  ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দ্বিমুখী রাজনীতির ফল বেকাদায় জাতীয় পার্টি

প্রায় সব ইস্যুতে সরকারের সুরে কথা বললেও কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক প্রাণহানি এবং সংঘর্ষের বিষয়ে আওয়ামী লীগের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল সদ্য ভেঙে দেওয়া জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে দ্বিমুখী রাজনীতির জেরে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বেকায়দায় রয়েছে দলটি। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাস হারিয়েছেন দলের নেতারা। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে অস্তিত্ব জানান দিলেও প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ভরসা পাচ্ছেন না জাপার নীতিনির্ধারকরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির শীর্ষ নেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নামে ‘প্রধান বিরোধী দল’ হলেও গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ইশারায় চলেছে জাতীয় পার্টির সব কার্যক্রম। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বয়কট করলেও বিগত তিনটি নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে এক সময়ের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল। আওয়ামী লীগের সাজানো নির্বাচনগুলোয় ‘প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অনুগ্রহই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে পূর্বনির্ধারিত সংখ্যক সংসদীয় আসনে জেতার পর বিরোধী দলের আসনে বসার এমন নজির সম্ভবত বিরল। শুধু নির্বাচন নয়, জাতীয় পার্টি গত ১৫ বছর ধরে সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এমনকি দলীয় কোন্দল কিংবা পারিবারিক সমস্যা মেটাতেও দলটির শীর্ষ নেতারা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হতেন। নামে বিরোধী দল হলেও জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতে কখনো রাজপথে নামতে দেখা যায়নি তাদের। কোনো কোনো বিষয়ে সংসদে গরম বক্তৃতা দিলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সব ধরনের বিতর্কিত কাজেই সায় ছিল দলটির। সংসদে বিল পাসের সময় জাপা এমপিরা হয় পক্ষে ভোট দিতেন অথবা ভোটদানে বিরত থাকতেন। এসব কারণে একসময় দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত জাপা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের মতোই কোণঠাসা অবস্থা জাতীয় পার্টির। দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তি, নেতাদের সুবিধাবাদী প্রবণতা এবং কোন্দলের কারণে এ দলটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছে দলটি।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতিক বিশ্লেষক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সরকারে থেকে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছে, সাধারণ মানুষ এটি মোটেও গ্রহণ করেনি, তারা জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের লেজ হিসাবেই বিবেচনায় নিয়েছে। দলটির কাছে মানুষের তেমন আর কোনো প্রত্যাশা নেই। তারা দেশের মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাদের কথা ও কাজের কোনো মূল্য নেই। এ দলটি ধীরে ধীরে নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে।’

দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সাল থেকে নিজেদের শক্তির পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে গাঁটছড়া বাঁধে দলটি। এতে জাপার কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দল ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বারবার আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছেড়ে এককভাবে পথ চলতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন।

এতে শীর্ষ নেতাদের কাছে বিরাগভাজন হয়েছেন কেউ কেউ। দলের সমালোচনা করায় বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।

জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা মনে করেন, শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের ওপর এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে, গত ১৫ বছর তারা জনগণের সমস্যা নিয়ে রাজপথে কোনো কর্মসূচি দেননি। এতে জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। দিন দিন কমেছে কর্মী-সমর্থক ও রাজনৈতিক শক্তি। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাস হারিয়েছে দলটি। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাপা নেতাদেরও গা ঢাকা দিতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিলেও প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ভরসা পাচ্ছেন না নেতারা।

বিশ্লেষকদের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের কাছে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া থাকা স্বাভাবিক। তা ছাড়া জাতীয় সংসদে টানা তিন মেয়াদে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষের চাওয়া খুব বেশি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অথচ গত তিন মেয়াদে কখনো মানুষের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়ায়নি জাতীয় পার্টি। শুধু তাই নয়, মাঠপর্যায়ে দলীয় কার্যক্রমও চোখে পড়েনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের কাছে যাওয়ায় কোনো প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টাও ছিল না। সংসদে গরম বক্তৃতা আর ঢাকায় নির্ধারিত কয়েকটি মিলনায়তনেই সীমাবদ্ধ ছিল জাতীয় পার্টির রাজনীতি।

গত তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের দোসরের ভূমিকায় ছিল জাতীয় পার্টি। দেশের অধিকাংশ দল বয়কট করলেও নানা নাটকীয়তা তৈরি করে শেষ পর্যন্ত ভোটে গেছে জাতীয় পার্টি। প্রতিবারই সমঝোতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন বাগিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল লক্ষ্য। নামে বিরোধী দল হলেও জাপার আসনে ক্ষমতাসীনরা কোনো প্রার্থী দেয়নি।

প্রতিটি নির্বাচনের পরই সংসদে ‘প্রধান বিরোধী দল’ হয়েছে জাতীয় পার্টি। এক্ষেত্রে দলটির নেতাদের পেছনে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছিলেন এরশাদ। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরকে করা হয়েছিল বিরোধীদলীয় নেতা। এছাড়া জাপা নেতাদের অনেকে বিরোধীদলীয় নেতা, হুইপ ও সংসদ সদস্য হিসেবে সুবিধা পেয়েছেন; কিন্তু মানুষের কোনো প্রত্যাশাই পূরণ করতে পারেননি তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত সাড়ে ১৫ বছর গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত কোনো কাজেই দলটি রাজনৈতিকভাবে শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি। জাপা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে বিগত সরকার একতরফাভাবে বিতর্কিত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করত। বাস্তবে জাপা তা করতে পারেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ঘুষ, খুন, গুম, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থপাচার, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল, বাকস্বাধীনতা হরণসহ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। সাইবার নিরাপত্তা বিল, নির্বাচন কমিশন আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্ক হলেও কার্যকর ভূমিকা নেয়নি জাপা। কোনো কোনো সময় লোক দেখানো বিরোধিতা করলেও সংসদে আইন পাসের সময় হয় সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে অথবা নীরব থেকেছে। দু-একটি ক্ষেত্রে ওয়াকআউট করার নজির থাকলেও তা লোক দেখানো বলে অনেকে মনে করেন।

সংসদ তো বটেই নিজেদের দল চালাতেও পুরোপুরি সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল জাতীয় পার্টি।

জাপার বিভিন্ন ধারার অনেক নেতার মূল্যায়ন, জাপায় গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। শীর্ষ নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থের বিনিময়ে যাকে তাকে দলীয় পদ কিংবা নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন। চেয়ারম্যান যখন যাকে খুশি বহিষ্কার করেছেন, আবার তা তুলেও নিয়েছেন। এসব প্রবণতার কারণে জাপা নেতারা কখনো গণতন্ত্রের জন্য রাজপথের লড়াই সংগ্রাম করেনি। জনবান্ধব কর্মসূচিও নেই দলটির।

জাপা রওশনপন্থি অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘কাজের সঙ্গে কথার কোনো মিল না থাকায় জাতীয় পার্টি গণমানুষের দল হতে পারেনি। জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। তিনি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রীয় নেতা ও তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে দল পরিচালনাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের চরম কর্তৃত্ববাদী নীতির অনুসঙ্গ হওয়ার কারণে আমাদের দল দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কাজী ফিরোজ রশীদ, ‘দিনের পর দিন দলে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে। এ কারণে জাপা জনতার কাতার ও মানুষের মন থেকে সরে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ দলটির প্রতি একেবারেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কোনোভাবেই তা পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না।’

জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। মূলত এ কারণেই হয়তো সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে, তাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি জাতীয় পার্টি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close