নিজস্ব প্রতিবেদক
সংস্কারের পর নির্বাচন
দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়
প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন পর ফের গতকাল শনিবার রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ দাবি জানিয়েছেন দলগুলো নেতারা।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দলগুলো কমন প্রস্তাবের বাইরে নানা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দিয়েছেন। একদিনের এ সংলাপে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আগেই সংলাপ হওয়ার কারণে তাদের এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় চার সপ্তাহ পর রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ে বসেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সংলাপে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) পক্ষ থেকে ৮৩টি সুপারিশ দিয়েছে এবং বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে ৭টি ইসলামি দল। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বৈঠক শেষে দলগুলোর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে তাদের দেওয়া প্রস্তাবগুলো ব্রিফিং করেন।
বৈঠক শেষে দলটির প্রধান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, এলডিপির পক্ষ থেকে আমরা ৮৩টি সুপারিশ করেছি। এগুলো দলীয় কোনো উপকারের জন্য না, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য না। আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সুবিধার জন্য না। নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, সংস্কারের পূর্বে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন নয়। তবে অবশ্যই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের জন্য দ্রুত ভালো। সেটি ৬ মাস হোক ৯ মাস পরে হোক। তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যতগুলো ধর্মবিরোধী লেখা-গল্প আছে সেগুলো সব বাদ দিতে হবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করব, নিজের স্বার্থ ভুলে যান, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ভুলে যান। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেন, সে পরিকল্পনা করেন। এ নেতা বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমি প্রথম সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করি। শেখ মুজিব বিদ্রোহ করেনি। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলে গিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য একটি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। এখনো আমরা বাংলাদেশকে চাঁদাবাজ মুক্ত করতে পারিনি। স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে দেশ, চাঁদাবাজ মুক্ত হয় নাই। এখনো কোর্ট কাচারিতে ন্যায় বিচার হচ্ছে না। মানুষ ন্যায়বিচার না পেলে এ স্বাধীনতার কোনো দাম নেই।
এদিকে বাংলাদেশ খেলাফতের মাওলানা মামুনুল হক বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আনার দাবি জানিয়েছি। সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ইসলামবিরোধী কোনো আইন যেন না আসে। সর্বশেষ দুবারের অধিক যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী না হয়। আন্দোলনের সব হত্যাকান্ডে প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করতে হবে দাবি জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, কালবিলম্ব না করে আন্দোলনের সব হত্যাকান্ডে দ্রুত বিচার করার দাবি করি এবং হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহার করার দাবি জানান। এর আগে বিকেল ৩টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে এ বৈঠক শুরু হয়। অংশ নেন খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলামী, জমিয়তে উলামে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামী ইসলামের নেতারা।
আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে ১৩টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দলটির আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম (চরমোনাই পীর)। দলটির দেওয়া প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে- বিদ্যমান সংবিধান নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক আছে, বিগত দিনের ক্ষমতাসীনরা দলীয় স্বার্থে সংবিধানে নানারকম পরিবর্তন করেছে। এ জন্য বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা, গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যার বিচার করতে হবে, একই সঙ্গে গত ১৬ বছরে যেসব হত্যা, গণহত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে সে সবের বিচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তদন্তসাপেক্ষে দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীদের সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে এবং পাচার করা টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের সম্পদের হিসাব নিতে হবে, দুর্নীতি ও টাকা পাচারের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের যেসব কর্মচারী আইন, সংবিধান, শপথ লঙ্ঘন করে অপেশাদার আচরণ করেছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনটি ভুয়া নির্বাচন করেছে, এ তিনটি অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনাকারী নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের যে সব কর্মকর্তা তাদের অবৈধ কাজের কুশীলব ছিলেন তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ অবৈধ নির্বাচনের সাহস না করে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে ইসিকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যম এ পাঁচটি ক্ষেত্রে আমূল এবং ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা, আমরাও মনে করি এসব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন, ইসলামী আন্দোলন প্রত্যাশা করে, অন্তর্র্বর্তী সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরণ ও প্রক্রিয়া কি হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতিদ্রুত প্রকাশ করবে এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। আওয়ামী দুঃশাসনে বিগত ১৬ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের সাধারণ শিক্ষাখাতের মান ও নৈতিকত। এ ক্ষতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ও উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শিক্ষাকমিশন গঠন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ঢালাওভাবে রাতারাতি যেসব নিয়োগ, বদলি ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এসব বিশ্লেষণের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে। ঢালাওভাবে হয়রানিমূলক এবং মিথ্যা মামলা করা যাবে না, শুধু রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা মামলা হলে তা প্রত্যাহার করতে হবে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতির বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। নতুন করে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও হয়রানি কঠোরভাবে দমন করতে হবে এবং চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অবৈধ অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসীদের দমন করতে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দ্রুত যৌথ অভিযান শুরু করতে হবে।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ-পরবর্তী সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টার মতবিনিময় করার প্রস্তুতি চলছে।
প্রসঙ্গক্রমে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৪ আগস্ট থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রশ্নে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি জানাচ্ছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ ধারাবাহিক মতবিনিময় সভা করলেন প্রধান উপদেষ্টা।
"