জাহিদুল ইসলাম
কমার্স ব্যাংকের ডিএমডির আমলনামা
লাখ টাকার কর্মকর্তার শত শত কোটির সম্পদ
সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে (বিসিবি) চতুর্থ শ্রেণির শতাধিক কর্মচারীকে বিনা নোটিসে চাকরিচ্যুতির ঘটনায় ব্যাংক খাতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের গণ্ডির ছাড়িয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, এমনকি সদ্য বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায় এই ঘটনার জল। কিন্তু এরপরও কোনো সুরাহা হয়নি। কারণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ব্যাংক খাতের মাফিয়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এস আলম গ্রুপ। অবশেষে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর ভাগ্যাহত কর্মচারীদের ভাগ্যে যেন সিঁকে ছেড়ে। তবে এসব ঘটনার নেপথ্যে যিনি মূল কারিগর, সেই উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আবদুল কাদের রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কর্মচারীদের চাপে গত ১১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি থেকে পদত্যাগ করে নিরাপদে সরে পড়েন। কিন্তু অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত আবদুল কাদেরের কয়েক শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবার রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের দাবি তুলেছেন হয়রানির শিকার ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা।
জানা গেছে, গত রমজানের ঈদের মাত্র দুদিন আগে ৭ এপ্রিল কোনো বেতন বোনাস না দিয়েই হঠাৎ চাকরিচ্যুত করা হয় কমার্স ব্যাংকের অ্যাটেনডেন্ট, ড্রাইভারসহ চতুর্থ শ্রেণির ১২০ কর্মচারীকে। আকস্মিকভাবে চাকরি হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখে এসব কর্মচারী। অনেকেরই রয়েছে গৃহ নির্মাণে ব্যাংক লোনের কিস্তি পরিশোধের চাপ। এর ওপর নিজেদের খাওয়া-পরা আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন তারা। ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককেও তোয়াক্কা করেনি কমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগীরা জানান, কমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরিচ্যুত কর্মচারীদের পুনরায় চাকরিতে বহাল ও নিয়মিতকরণে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি শোকজ করা হয় কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে। কিন্তু এতেও টনক নড়েনি। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন চাকরিচ্যুত ১২০ জন কর্মচারী ও তাদের পরিবার। অন্যদিকে, ঘটনার নেপথ্যে থাকা ডিএমডি আবদুল কাদের গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
ওমর হাসান নামে প্রতিষ্ঠানটির এক ড্রাইভার জানান, আবদুল কাদের ছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী। ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ লুটেপুটে খেতেই নিজের বিশ্বস্ত সহচরদের নিয়োগ দেয় এস আলম। তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতেন না আবদুল কাদের। বিভিন্ন সময় নিয়োগ বাণিজ্য করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে এই আবদুল কাদের। ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে সাকুল্যে চার লাখ টাকা বেতন পেলেও রাজধানীর বুকে আলিশান বাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট, প্রায় অর্ধ ডজন দামি গাড়ি, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামের বাড়িতে বিশাল গরুর খামারসহ শত বিঘা জমির মালিক এই আবদুল কাদের। যার বাজারমূল্য কয়েক শত কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত চালায় প্রতিদিনের সংবাদ। এতে দেখা যায়, রাজধানীর মণিপুরীপাড়ার ১০০নং হোল্ডিংয়ে অত্যাধুনিক ও দামি আসবাবপত্র সজ্জিত ফ্ল্যাট রয়েছে এই কর্মকর্তার। এ ছাড়া রাজস্ব বোর্ডে কর্মরত ভায়রার সঙ্গে মিলে ইস্কাটনের বিএম গলিতে ক্রয় করেছেন সাইনপুকুর অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট। সাভারের আশুলিয়া বাজারের কলেজ রোডের আশুলিয়া টাওয়ারে রেমেডি জেনারেল হসপিটাল নামে একটি হাসপাতালও রয়েছে এই ব্যাংক কর্মকর্তার। অবশ্য তার নিজ ভাই সুমনের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। আবার ছোট বোন রাবেয়া বেগমের পরিচালনায় রয়েছে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে ‘স্মার্ট অ্যান্ড ডিসেন্ট’ নামে তৈরি পোশাকের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাছাড়া নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরের খিলবাইছার মতলবপুর গ্রামে প্রধান সড়কের সঙ্গে উঁচু দেয়াল ঘেরা সীমানা প্রাচীরসহ আধুনিক ডিজাইনের একতলা বাড়িসহ গবাদিপশুর খামার। আবার ঢাকার ডেমরাতেও জমিসহ পাঁচতলা ভবন রয়েছে বলে জানা গেছে।
কমার্স ব্যাংকের এই কর্মকর্তার সাকুল্যে বেতন ৩ লাখ টাকার কিছু বেশি হলেও তার রয়েছে বিলাস বহুল গাড়ি। মণিপুরীপাড়ার ভবনের নিচেই রয়েছে পুলিশের স্টিকার লাগানো কাগজপত্রহীন একটি টয়োটা প্রাডো গাড়ি (যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৪-০৭৯৪), যেটি মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া হয়। আবদুল কাদেরের স্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় স্টিকার লাগানো গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন।
বর্তমান বাজারমূল্যে এ ধরনের একটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা দামের নিশান এক্সট্রাইল, কালো রঙের টয়োটা অ্যালিয়ন, এক্স-করোলা ও হায়েস মাইক্রোবাস। গাড়িগুলোর কোনোটা রয়েছে সাইনপুকুর অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে, কোনোটি রয়েছে রমনা মসজিদসংলগ্ন পুলিশ কোয়ার্টার এবং সাভারের রেমিডি হাসপাতালে।
ভুক্তভোগীদের বরাতে জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের কৃষি ভবন শাখা, ওয়ান ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখাসহ বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে একাধিক হিসাব চালু আছে। এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই হয় বিভিন্ন অনৈতিক লেনদেন।
অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তার নির্দেশনাতেই গত ২১ মে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার ও অ্যাটেনডেন্ট পদে ৪৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার ২০২৩ সালের শেষ দিকে কোনো সার্কুলার ছাড়াই ৬৫ জনকে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত ২১ এপ্রিল ৩৪২ জন কর্মকর্তাকে পরবর্তী পদে পদোন্নতি দিতেও অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয় ৯ জনকে, যাদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে গড়পড়তায় ৩৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি। এই পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ট্রেজারি ডিভিশনের আফজাল হোসেন খান নামে এক কর্মকর্তার পদোন্নতিকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে সমালোচিত হয়েছে। কারণ ওই কর্মকর্তার নামে দুদকের অভিযোগ ও আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এভাবেই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে ডিএমডি আবদুল কাদের। অথচ সামান্য বেতনে চাকরি করা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওপরেই নেমে এসেছে দুর্ভোগ। অর্থ পাচার, মানিলন্ডারিংসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও আবদুল কাদের ছিলেন স্বপদে বহাল। কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রমাদ গুনতে থাকেন বিসিবির দাপুটে এই কর্মকর্তা। অবশেষে গত ১১ আগস্ট ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে পদত্যাগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জানান, এক কথায় কমার্স ব্যাংকটাকে ধ্বংস করেছে কাদের। একনায়কতন্ত্র প্রথা চালু করে গত রমজানের ঈদের দুদিন আগে ১২০ জনকে চাকরিচ্যুত করেছেন। মূলত নিজের সুরক্ষার জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ৮ আগস্ট অস্ত্রসহ দুজন বহিরাগত সন্ত্রাসী সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করেন আবদুল কাদের। এর প্রতিবাদ করলে সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসীদের গুলি করতে বলেন আবদুল কাদের। এতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় আবদুল কাদের ইউনিয়ন ব্যাংকে থাকাকালীন যাদের চাকরিচ্যুত করেছেন তারাও কমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রতিবাদকারীরা জানান, ইউনিয়ন ব্যাংকে থাকাকালে আবদুল কাদের ২৫ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছেন। উত্তেজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাদেরকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করতে থাকে। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। অবশেষে পদত্যাগ করলে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হয়।
আবদুল কাদেরের এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের দরবেশখ্যাত এস আলম গ্রুপের মাসুদের টাকা পাচার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি আবদুল কাদের। ব্যাংক থেকে প্রথমে লিজিং কোম্পানিতে টাকা ট্রান্সফার করে পরে হুন্ডি বা অন্য মাধ্যমে সে টাকা পাচার করে।
সূত্রটি জানায়, চলতি বছরেও একসঙ্গে ব্যাংকের ৬৫০ কোটি টাকা এস আলমের রিলায়ান্স ফাইন্যান্স অ্যাকাউন্টে জমা করেন আবদুল কাদের। ওই টাকাই পরবর্তীতে পাচার হয়ে বিদেশে এস আলমের আরেকটি অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়।
তিনি আরো জানান, নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরে ৫০০ একর জমির ওপরে তার খামার রয়েছে। বসুন্ধরা মার্কেটে রয়েছে ৮টি দোকান, যার আনুমানিক মূল্য ৪০-৪৫ কোটি টাকা। ঢাকায় একাধিক বাড়ি, মিরপুর বাউনিয়া এলাকায় একসঙ্গে ৩টি বাড়ি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৫ কোটি টাকা। বসুন্ধরায় যে ফ্ল্যাট আছে তার মূল্য ৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া সাভারের একটি সিএনজি বেয়ারিং ফ্যাক্টরিতে তার ইনভেস্টমেন্ট ২০ কোটি টাকা। তিনি ও তার স্ত্রী মিলে মালয়েশিয়া, দুবাই ও ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।
আবদুল কাদেরের ব্যক্তিগত এক গাড়িচালক বলেন, গাড়িতে করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বাসায় আনতেন। মিরপুরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এফডিআর আনতেন ১-২% কমিশনে। এ ছাড়া ব্যাংকের ইক্যুইপমেন্ট কেনাকাটাতেও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে আবদুল কাদেরের কাছে জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলামের কাছেও এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
"