কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম
‘আরার ইউনূস দেশর প্রধান উপদেষ্টা অইয়ে’
‘আরার ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অইয়ে’ (আমাদের ইউনূস দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন)। চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে এটিই এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে তিনি হাল ধরতে এগিয়ে আসায় খুশি চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ; আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছেন হাটহাজারীর প্রবাসী সন্তানরাও।
ইউনূসের জন্মস্থান হাটহাজারীর বাথুয়া গ্রামের কলেজছাত্র মোরশেদ আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা উনার কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো দেখিনি। তিনি আমার গ্রামের মানুষ- এটি ভাবতেও ভালো লাগছে।’ প্রবাস থেকে মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘গরিবের জন্য তিনি অন্তঃপ্রাণ। জোবরা গ্রামের উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আমি আশা করি, দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব প্রবাসী সম্প্রতি আন্দোলন করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন মেয়াদ কারদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, তিনি তাদের মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নেবেন।’
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে ১৯৪০ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার বাবা হাজি দুলা মিয়া ও মা সুফিয়া খাতুন। ড. ইউনূসের শিক্ষাজীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে। পরবর্তী সময়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। জীবনের শুরু থেকে নাটক, লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। যুক্ত ছিলেন স্কাউটেও। স্কাউটিং করে ১৫ বছর বয়সেই তিনি আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপের নানা দেশ ঘোরেন। অসম্ভব মেধার অধিকারী ড. ইউনূস ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে নেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে থাকার পর ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্করারশিপ পান। যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য সাংগঠনিকভাবে নানা কাজে লিপ্ত থাকেন। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
নতুন বিভাগ হওয়ায় তখন বিভাগে তেমন কোনো কাজ ছিল না। এজন্য তিনি আশপাশের গ্রামে ঘুরতেন। সেখানকার মানুষের জন্য কিছু করতেন চাইতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘রুরাল ইকোনমিক্স প্রোগ্রামের’ প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তখন জোবরা এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোয় শুরু করেছিলেন একটি মাঠ গবেষণা, যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। সেখানে শুরুতে তেভাগা পদ্ধতি কৃষকের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের কার্যক্রম শুরু করেন অধ্যাপক ইউনূস। যার নাম ছিল নবযুগ তেভাগা খামার।
অধ্যাপক ইউনূস তখন বলছিলেন, ‘জমি যার সে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যে বীজ দেবে সার দেবে সে পাবে এক ভাগ। আর চাষ করবে, পানি দেবে সে পাবে এক ভাগ। এরকম করে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম।’ পরে গ্রামের অবহেলিত নারী ও পুরুষদের নিয়ে একটা সমিতি শুরু করেন। সেই সমিতিতে সঞ্চয় করত সবাই। এ কৃষকের খামার থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পরবর্তী সময়ে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের।
গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ভূমিহীন এবং দরিদ্র নারীদের পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে এবং এ ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্রদের রক্ষা করতে ব্যাংক অন্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচঋণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থাও চালু হয়। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলো এটি মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এ কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করলে ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। ধীরে ধীরে তিনি বিশ্বের কাছে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল হতে থাকে।
সম্মাননা : ড. ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৮টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডাল গ্রহণ করেছেন। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্মাননা দেওয়া হয় ইউনূসকে, যিনি এ পদক পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ও মুসলিম। বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদশালী দুই শতাধিক ব্যক্তির সম্মেলনে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ মে বুধবার জাতিসংঘ ভবনে এ সম্মাননা জানানো হয়। জাতিসংঘে বিশ্বের সম্পদশালী ব্যক্তিদের এ সমাবেশের আয়োজন করে বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন। একজন সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে ইউনূসকে এ ‘আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সর্বশেষ ২০০৬ সালের ২৫ অক্টোবর কাছে পান। এ সময় তিনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তরুণ বয়সে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করে কিছু পাগলামি করেছিলাম, কিছু কাজও করেছিলাম। যখন আমি জোবরা গ্রামে কৃষককে নিয়ে এ কাজ শুরু করি আমাকে অনেকেই বলেছিল, এসব পাগলামি করে কিছু হবে না। এ পাগলামিই যে আমাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ আসনে বসাবে কে জানত! তিনি আরো বলেছিলেন, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি নাড়ির টানে। জোবরা গ্রামকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্বৃত্ত গ্রাম গঠন করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যেই আমি কাজ শুরু করেছিলাম। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম।
নোবেল প্রাপ্তিতে চবি ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে উল্লে করে তিনি বলেছিলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিশাল এ কর্মকাণ্ডের বীজ বোনা হয়েছিল। আর ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে গল্প সৃষ্টি হয়েছে, তা যে চবি থেকে শুরু হয়েছিল এতে কোনো বিতর্ক নেই। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, শিক্ষকতা শুরু করার সময় ছাত্র ও সহকর্মীদের নিয়ে যে কাজ করেছিলাম, তা আজ ১২০টি দেশে ১০০ মিলিয়ন লোকের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষকতা শুরুতে ছাত্রদের নিয়ে ইরি ধান লাগিয়েছি, খামার করেছি। জোবরার বড়ুয়াপাড়ায় জীবনাশ্রী বিদ্যালয় গড়ে তুলেছি। নাম দিয়ে রাজনীতি করতে হবে না, টাকা দিয়েওতো অনেক লোক নাম দিতে পারে। পরে চবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নাম ড. ইউনূসের নামে করা হয়।
"