নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিবি হেফাজতে স্বেচ্ছায় বিবৃতি দেননি সমন্বয়করা
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে থাকা এবং সেখান থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি নিয়ে মুখ খুলেছেন। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেছেন, ছয় দিন আগে যে বিবৃতিটি তারা দিয়েছিলেন, সেটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ৬ সমন্বয়কের ভিডিও স্টেটমেন্টটি আমরা স্বেচ্ছায় দিইনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সিদ্ধান্ত ডিবি অফিস থেকে আসতে পারে না। সারা দেশের সব সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে না। ডিবি অফিসে আমাদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। আমাদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় এবং মিডিয়ায় মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হয়। আমাদের শিক্ষকরা দেখা করতে এলে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।’ ছাত্র-নাগরিক হত্যার বিচার ও আটক নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলেও বিবৃতিতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিটি সাংবাদিকদের বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠানোর পাশাপাশি কয়েকজন সমন্বয়ক তাদের ফেসবুক আইডি থেকেও প্রচার করেছেন। বিবৃতির বিষয়ে ৬ সমন্বয়কের একজন আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা ছয়জন সমন্বয় করেই এ বিবৃতি দিয়েছি।’ তবে ৬ সমন্বয়কের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ডিবির সাবেক ও বর্তমান প্রধান দুজনই বলেছেন, তাদের ওপর জোর করার কোনো ঘটনা ঘটেনি। জুলাইয়ের প্রথম থেকে শুরু কোটা আন্দোলন ধাপে ধাপে প্রাণঘাতী সহিংসতায় রূপ নিলে কারফিউ জারি এবং সেনা নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার পর গত ২৬ জুলাই ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩ সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরদিন আরো ২ সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকেও ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এরপর ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ভোররাতে জোর করে ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। তবে তখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হেফাজতে নিয়েছে ডিবি। নুসরাতকে যেদিন নিয়ে যাওয়া হয়, ওইদিনই ডিবি কার্যালয় থেকে এক ভিডিওবার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন ৬ সমন্বয়ক। ওইদিন রাতে ডিবি হারুন তার ফেসবুকে ৬ সমন্বয়ককে নিয়ে টেবিলে খাবার খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন। পরে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে হারুন দাবি করেন, ৬ সমন্বয়কের কাছ থেকে জোর করে বিবৃতি নেওয়া হয়নি।
সমালোচনার মুখে গত ৩১ জুলাই ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক আদেশে হারুনকে ডিবি থেকে সরিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যেয়ে খাবারের টেবিলে বসিয়ে তোলা ছবি হারুনের ফেসবুকে দেওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট। গত ২৯ জুলাই একটি রিট আবেদনের শুনানিতে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না।’ নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত বৃহস্পতিবার ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দিয়ে তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বাবা জানান, ডিবি কার্যালয়ে ছয়জন ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলেন।
শুক্রবারের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অন্যায়ভাবে সমন্বয়কদের আটক, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ৩০ জুলাই রাত থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের ডিবি অফিসে আটক অবস্থায় অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সে খবর জানামাত্র সারজিস আলম, হাসনাত আবদুলাহ ও নুসরাত তাবাসসুমও অনশন শুরু করেন। অনশনের কথা পরিবার ও মিডিয়া থেকে গোপন করা হয়। প্রায় ৩২ ঘণ্টারও অধিক সময় অনশনের পর ডিবিপ্রধান ৬ সমন্বয়ককে মুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে অনশন ভাঙা হয়। আমাদের ১ অগাস্ট দুপুর ১.৩০টায় পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। গত সাত দিন ডিবি অফিসে আমাদের ও আমাদের পরিবারের সঙ্গে নানা হয়রানি, নির্যাতন ও নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মূলত আন্দোলন ও নেতৃত্বকে ছত্রভঙ্গ করতেই ১৯ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার নামে ৬ সমন্বয়ককে সাত দিন ধরে ডিবি হেফাজতে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিবিপ্রধান নিরাপত্তার কথা বললেও আমাদের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যই ডিবি হেফাজতে রাখা হয়েছিল। আমরা গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম; আমরা আমাদের মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূতভাবে আমাদের ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা হয়। প্রথমে নিরাপত্তার কথা বললেও পরে আদালতের কথা বলা হয়। আদালতের আদেশ ছাড়া নাকি আমাদের ছাড়া যাবে না।’
এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘তারা যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা স্বেচ্ছায় দিয়েছেন। কোনো অন্যায় করা হয়নি।’ তাদের আত্মীয়স্বজন পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমেও একই কথা বলেছেন বলে জানান তিনি। গোয়েন্দা পুলিশে হারুনের স্থলাভিষিক্ত অতিরিক্ত কমিশনার মুহা. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘তারা তখন স্বীকার করে গেছেন আমাদের কাছে। তারা উইলিংলি (বিবৃতি) দিয়েছেন আমাদের কাছে, ভিডিওটা দেখলে বোঝা যায়। কেউ যদি ওখান থেকে করে, তাহলে তো এটা তার নীতি-নৈতিকতার বিষয়।’ জোর করে খাওয়ানোর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা ডিবির কাছে বেশ কয়েকদিন ছিলেন। তারা তো বিভিন্ন সময় খেয়েছেন। তারা এ ধরনের যেসব কথা বলছেন, তা ঠিক নয়।’
"