নিজস্ব প্রতিবেদক
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে বেকায়দায় বিএনপি
বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতা ও ব্যাপক প্রাণহানির জন্য দায়ী করে জামায়াত-শিবিরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের পর বিএনপি নেতারা হতাশ। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানান। গত দুদিন থেকে বিএনপি ও জামায়াত সংশ্লিষ্ট নেতারা সরকারের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করতে দেখা গেছে। বিএনপির ডাকা জাতীয় ঐক্য জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেওয়ার একদিনের মাথায় নিষিদ্ধ হয় দলটি। ঐক্যের আন্দোলন বেগবান করতে বিএনপিকে জামায়াতের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে। এখন তারা নিষিদ্ধে বিএনপির নেতারা বেশ হতাশ। এ বিষয়টি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবৃতিতে প্রকাশ পায়। বিএনপির দেওয়া বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল জানান, আন্তর্জাতিকমানের ন্যায়সঙ্গত ও বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত ছাড়াই কোনো রাজনৈতিক দলকে অপবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অন্যায় এবং সংবিধান সম্মত নয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার অধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বদান্যতায়। তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পরেই রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এক অধ্যাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ধারাটি বাতিল করেন।
১৯৭৬ সালে জামায়াত রাজনীতিতে আসে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা আইডিএল নামে দিয়ে। ১৯৭৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আজম অনেকটা গোপনীয়তার সঙ্গে দেশে ফেরেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে। ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও তাকে কিছু বলেনি সরকার। ১৯৮১ সালে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে। এরপর ১৯৯৯ সালে দল দুটি পুনরায় জোট গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আলবদর বাহিনীর দুই নেতা মতিউর রহমানী নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব পান।
প্রায় দুই যুগ টিকিয়ে রাখা জোট ভেঙে দেওয়া হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। সে সময় বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি বিএনপি আবার জামায়াতসহ সব দলের কাছে বৃহত্তর ঐক্যের বার্তা দিয়েছে।
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কোটা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ‘গণহত্যা, নৃশংসতা, ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্মমণ্ডনির্দয় দমন নিপীড়নের জন্য’ সরকার দেশ-বিদেশে যখন তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও চাপের মুখোমুখী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম যখন সরকারকে জবাবদিহি করতে বলেছে, দেশে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, যুবক, নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিবাদমুখর ধিক্কার জানিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ পদত্যাগের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন ও চাপে রাখতে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তদন্ত ছাড়াই নিজেদের দায়-দায়িত্ব বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’।
ছাত্র আন্দোলনে ‘গণহত্যার দায়ে’ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগের দাবিকে ধামাচাপা দিতে নতুন বিতর্ক সামনে আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির এ নেতা। বলেন, যা বুমেরাং হতে বাধ্য।
‘নন ইস্যুকে’ ইস্যু বানানোর ‘পুরোনো কার্ড’ নতুন করে খেলে আওয়ামী লীগ জনদৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব। বলেন, শত শত ছাত্র, কিশোর, যুবক, শিশুসহ জনতার রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না।
‘হটকারী সিদ্ধান্ত’ নিয়ে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি আরো জটিল ও সংঘাতময় করে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অভিযোগও আনেন মির্জা ফখরুল।
উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ মোকাবিলা করাই রাজনৈতিক দলের কাজ মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নির্মূল বা ধ্বংস কিংবা নিষিদ্ধ করতে সিদ্ধহস্ত। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে’।
বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দাবি করে দলের মহাসচিব বলেন, ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস- শহীদ জিয়ার এ উক্তিকে ধারণ করে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ নয়, উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলায় বিশ্বাসী।’
আওয়ামী লীগ এমন নীতিতে বিশ্বাসী অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জাসদকে নির্মূল, ধ্বংস করতে হত্যাযজ্ঞ ও নির্মমভাবে দমন নিপীড়ন চালিয়েছিল তারা’।
এ জাসদকে আওয়ামী লীগ এক সময় তাদের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রেক্ষাপট রচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করত, সেই জাসদের একেক সময় একেক ভগ্নাংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ এক সময় ১৫ দলীয়, ১৪ দলীয় জোট করেছে, সরকার গঠন করেছে, বর্তমানেও তাদের জোট আছে।
‘আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী সর্বদলীয় গণআন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।’
‘সে সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে গেলে কোরআন ও জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, উপহার দেওয়া-নেওয়ার সময় উভয় দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আজও অনেকের মানসপটে রয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ৯০ দশকে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনেও জামায়াত ও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সংসদের ভেতর-বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ করেছিল, সংসদ থেকে একত্রে পদত্যাগ করে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময়ে শেখ হাসিনা জামায়াতের নেতাদেরকে পাশে বসিয়ে একত্রে কর্মসূচি দেওয়ার ছবি আজও মানুষের দৃশ্যপটে ভাসে।
তখন জামায়াতে ইসলামীকে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বা জঙ্গি মনে হয় নাই। কারণ, তখন জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছিল। আজ জামায়াত আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ বিরোধিতা করছে। তারা আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গী নেই বলে আওয়ামী ভাষায় জঙ্গি হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ দেশে ‘জঙ্গির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক’ মন্তব্য করে বিএনপির এ নেতা বলেন, তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যাযজ্ঞে গোটা দেশ আজ অগ্নিগর্ভ, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, দেশকে আজ ব্যর্থ রাষ্ট্রে, জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে তারা।
"