নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৭ জুলাই, ২০২৪

দগদগে বিটিভি ভবনের ক্ষত

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বিশেষ করে রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনের ভেতর ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে তারা। হামলাকারীদের তাণ্ডবলীলায় বিটিভি ভবনের বিভিন্ন অবকাঠামো, সম্প্রচার সরঞ্জাম, নকশা বিভাগ, অফিস ভবন এবং বিভিন্ন কক্ষ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বিটিভি ভবনে গিয়ে সেই দগদগ ক্ষত স্বচক্ষে দেখলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার সকালে ক্ষতিগ্রস্ত বিটিভি ভবন পরিদর্শন করেন তিনি। সকাল সোয়া ৯টায় বিটিভি ভবনে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিটিভি ভবনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে হতাশ ও অসন্তুষ্ট দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে।

হামলাকারীরা গত ১৮ জুলাই দুপুর ৩টায় দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনের প্রধান ৪টি গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা ভবনের ভেতর ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। টেলিভিশন ভবনে কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি উল্লেখ করে খোঁজাখুঁজি করে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়। পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে সরকারি মালামাল ভাঙচুর ও ক্ষতিসাধন করে। এতে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৫০ কোটি টাকা। একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি রাত ৯টায় সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিটিভির পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাণ্ডবলীলায় বিটিভির বিভিন্ন অবকাঠামো, সম্প্রচার সরঞ্জাম, নকশা বিভাগ, অফিস ভবন এবং বিভিন্ন কক্ষ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

বিটিভির পরিসংখ্যান বলেছে, ভাঙচুরের ঘটনায় ১৯৬৪ সাল থেকে সংরক্ষিত অমূল্য প্রাচীন জিনিস দিয়ে সজ্জিত একটি টেলিভিশন জাদুঘর এবং মুজিব কর্নার, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, অভ্যর্থনা ও ওয়েটিং রুমের আসবাবপত্র, কম্পিউটার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক (এসি) এবং অন্য জিনিসপত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া প্রায় ৪০টি কম্পিউটার, ১০০টি টেলিভিশন সেট এবং কম্পিউটার ল্যাবের আসবাবপত্র, প্রশিক্ষণ কক্ষ ও প্রিভিউ রুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লিফট, নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম, সিসি ক্যামেরা ও মনিটরিং সেটও ভাঙচুর করা হয়। যানবাহন ভবন, শেড, ক্যান্টিন এবং নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ কক্ষ, একটি সম্প্রচার ওবি ভ্যানসহ ১৭টি গাড়ি, ২১টি মোটরসাইকেলে আগুন এবং ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। হামলায় অডিটোরিয়াম, লাউঞ্জ, ডিজাইন, মেক-আপ, ওয়ার্কশপ, গ্রাফিক্স রুম, স্টোর-ওয়ারড্রব রুম এবং ২০টি গ্রাফিকস কম্পিউটারও ভাঙচুর করা হয়। নকশার শেড, স্টুডিওর ছাদ, দেয়াল, ভবন এবং নাগরিক অবকাঠামো, কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং প্রায় ৭০টি এয়ার কন্ডিশনার (এসি), অফিসিয়াল আসবাবপত্র, পাঁচটি ফটোকপি মেশিন এবং প্রায় ৫০টি অফিসিয়াল কম্পিউটারও ভাঙচুর করা হয়। ১০টি কম্পিউটার ওয়ার্ক স্টেশন, বৈদ্যুতিক তার, সুইচ, স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি, রেকর্ডিং ক্যামেরা, আলোর উৎস এ সম্পর্কিত সরঞ্জামসহ ১০০ মনিটরিং সেট, গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক ফাইল, শিল্পীর সম্মানি-সম্পর্কিত খাতা, ব্যাংকের চেক বই, ভাউচার, অডিট বিল ইত্যাদিও ভাঙচুর করা হয়।

এরআগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পূর্বঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে পুরো ঢাকায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর-১০, বাড্ডা এবং আইডিয়াল কলেজের সামনে পুলিশের সঙ্গে দফায়-দফায় হয় সংঘর্ষ। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনা, রাজশাহী, যশোরও শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন হয়। এসব স্থানেও পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

বিটিভি ভবনে হামলার ঘটনায় বিএনপির ৬ নেতা কারাগারে : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) রামপুরা ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ ছয়জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। কারাগারে যাওয়া অপর পাঁচ আসামি হলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক, বিএনপির এমএ সালাম ও মাহমুদুস সালেহীন। গত রবিবার টুকুসহ ৬ আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

গতকাল শুক্রবার রিমান্ড শেষে আসামিদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অপর দিকে আসামিদের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরোবিয়া খানম তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মামলার অভিযোগে বাদী মাহফুজা আক্তার আরো উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ডিআইটি রোডগামী রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও বিটিভি ভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এরপরই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশে ও সক্রিয় অংশগ্রহণে অজ্ঞাতনামা তিন-চার হাজার কর্মী দলবদ্ধ হয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয়।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি সম্প্রচারকাজে নিয়োজিত পোর্টেবল ডিএসএনজি সিস্টেমের সব সম্প্রচার যন্ত্রপাতি, এসব যন্ত্রপাতি পরিবহন কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, কেন্দ্রীয় শীতাতপ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ, ১৭টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ৯টি গাড়ি ভাঙচুর, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২১টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর, বিটিভির মূল ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ঢাকা কেন্দ্রের রিসিপশনে অগ্নিসংযোগ, ট্রান্সপোর্ট ভবনে অগ্নিসংযোগ, ক্যান্টিনে, অডিটোরিয়ামে অগ্নিসংযোগ, মেকআপ শাখা ভাঙচুর, ডিজাইন শাখার মেকআপ (ওয়ার্কশপ, স্টোর, ওয়ারড্রব ও গ্রাফিক্স রুম) রুমে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে।

বিটিভি ভবন-মেট্রোরেলে সহিংসতায় গণঅধিকারের তারেকসহ গ্রেপ্তার ৪ : কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন, মেট্রোরেল ও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং নাশকতার ঘটনায় জড়িত গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গ্রেপ্তাররা হলেন- গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমান (৩১) ও তার সহযোগী মো. সজল মিয়া (২৪), আল ফয়সাল রকি (২৭) ও মো. আরিফুল ইসলাম (৩০)।

গত ২২ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান পরিচালনা তাদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল। অভিযানে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি শর্টগানের খালি খোসা, দুটি ল্যাপটপ, তিনটি সিপিইউ, একটি হার্ড ডিক্স, একটি মডেম, একটি এটিএমকার্ড, চারটি মোবাইল ফোন ও নগদ ১১ হাজার ৮৮৭ টাকা।

র‍্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলা, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগে গ্রেপ্তার আসামিরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী চক্রের নির্দেশনায় তারা এ হামলা ও নাশকতায় অংশ নেন। গ্রেপ্তার আসামিরা মূলত তারেকের নির্দেশনা ও নেতৃত্বে রাজধানীর বিটিভি ভবনসহ, মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশনসহ রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুরে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা ও অগ্নিসংযোগ করে। দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্রবিরোধী কুচক্রী মহলের সঙ্গে তারেক নিয়মিত যোগাযোগ করতেন বলেও জানায় র‌্যাব।

গত ২৩ জুলাই দুপুরে কারওয়ানবাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। চলমান নাশকতা ও সহিংসতায় র‍্যাবের হেলিকপ্টার টহলের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ জনগণসহ প্রায় ১০০ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close