নিজস্ব প্রতিবেদক
চীনের সহায়তায় লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ
বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ চীন। একাই নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল কিংবা খেলনা থেকে শুরু করে ফ্যাশন- এমন কোনো পণ্য নেই, যা রপ্তানি করে না চীন। ফলে পোশাকসহ বহুমুখী খাতে চীনা বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তায় শিল্প স্থাপন করে উৎপাদিত পণ্য চীন ও বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ। সর্বশেষ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে মাত্র ২৯০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধায়। বিজিএমইএ বলছে, চীনা কাঁচামালে পোশাক তৈরি করে আবার চীনে ফের পোশাক রপ্তানি করা কষ্টসাধ্য।
বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান কচি বলেন, চীনের সব কিছুই নিজেদের। আমাদের বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য তৈরি করতে হয়, তাই খরচ বেড়ে যায়। তবে বিজিএমইএর আরেক নেতা বলছেন, চলমান ভূরাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ এবং বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের বিকল্প খুঁজছে অনেক দেশ। তাই কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনসহ কিছু ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ এনে তৈরি পণ্য বিশ্বে রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ হিল রাকিবের মতে, চীনের সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় না গিয়ে বরং চীনের সহযোগিতা নিয়ে পণ্য উৎপাদন করলে, তা দুই দেশের জন্যই লাভের হবে।
বাংলাদেশ বায়ার্স কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, চীনে সরাসরি রপ্তানির চেয়ে বাংলাদেশের উচিত চীনা বিনিয়োগ এবং কারিগরি সহায়তায় উৎপাদন বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে অংশীদারত্ব বাড়ানো। পোশাক রপ্তানিতে ৩২ শতাংশ অংশীদারত্ব নিয়ে চীন এখনো বিশ্ববাজারে ১ নম্বরে। সেখানে দ্বিতীয় বাংলাদেশ। তবু প্রতিযোগী দুই দেশ বিশ্ববাজারে কৌশলগতভাবে কাজ করতে পারে মনে করেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ পর্যবেক্ষকরা।
অর্থের জন্য চীন কেন গুরুত্বপূর্ণ : এক দশক ধরে ছোট-বড় নানা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রাম টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে চীনা কোম্পানি। প্রায় শেষ হয়েছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’ বা এইআই গত বছর যে ধারণা দিয়েছিল, তাতে বাংলাদেশে মোট চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এছাড়া চীনের কয়েকটি কোম্পানি বিভিন্ন খাতে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ কার্যাদেশ পেয়ে কাজ সম্পন্ন করেছে কিংবা এখনো করছে।
বাংলাদেশের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও এখন সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রধান এম এ মান্নান বলেছেন, চীনের কাছ থেকে আর্থিক বা প্রকল্পগত সহায়তা চাওয়ার কারণ হলো চীন কখনো অন্যের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না। যেকোনো চুক্তি বা সমঝোতায় বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। তাই চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত রাজনৈতিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোয় চীনা সহায়তা চেয়ে থাকে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, সুদের হার, শর্ত, প্রযুক্তি এবং কম খরচ হবে- এসব চিন্তা করেই বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করে বলে তিনি মনে করেন। প্রথমত, ঋণটা সহজে পাওয়া যায়। অন্য দাতা সংস্থাগুলোর মতো ২ শতাংশ সুদেই ঋণ দেয় চীন। আর কস্ট বেনিফিট বিবেচনায় নিলে যেখান থেকে ঋণ পেলে সুবিধা সেদিকেই তো যাব আমরা। সে জন্যই চীন গুরুত্বপূর্ণ।
তার মতে, অবকাঠামো উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের প্রযুক্তি বা খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম হয়। তাছাড়া দেখতে হবে অর্থ দেওয়ার সক্ষমতা কার আছে। উপকরণের দাম কে কম নেবে। চীনের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ আছে, তা আর কারো কাছে নেই। তিনি আরো বলেন, চীন এখন অনেক সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। তাদের ঋণের ধরনেও আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। সে কারণেই তাদের অফার বাংলাদেশ বিবেচনা করে। তারা প্রযুক্তি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই সক্ষম। আর গুরুত্বপূর্ণ হলো চীন তাদের নিজেদের প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয় না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তারা বিনিয়োগ করছে যেখানে ঠিকাদার তাদের কিন্তু প্রযুক্তি অন্য দেশের।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইড ডাটার তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন চীনই বাংলাদেশের জন্য একক বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ২৩০ কোটি ডলার ঋণ কিংবা সহায়তা নিয়েছে চীনের কাছ থেকে। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত ৪ বছরে বাংলাদেশে ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে চীন থেকে।
"