গাজী শাহনেওয়াজ
দেশে অটো ব্রিকসের গন্তব্য অনিশ্চিত
দেশে পরিবেশবান্ধব ইট অর্থাৎ অটো ব্রিকসের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বড় পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে বিধায় অনেকেই এই শিল্পে উৎসাহিত হচ্ছেন কম। বলা যায়, বিশাল ব্যয়ের বেড়াজালে আটকা পড়েছে অটো ব্রিকস শিল্প। এর জন্য সরকার পরিবেশবান্ধব যে ইটের কারখানা দেশে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে ‘সে আশার গুড়েবালি’।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ দূষণকারী একটি প্রচলিত ইটভাটা নির্মাণে যেখানে ব্যয় মাত্র ৪-৫ কোটি টাকা, সেখানে কম দূষণকারী একটি অটো ব্রিকস ফিল্ড নির্মাণে ব্যয় অর্ধকোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয় বেশি হলেও অটো ব্রিকসে নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। এই সুবিধার চেয়ে শিল্প মালিকরা চিন্তা করছেন, বিপুল বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন কত বছরে উঠবে, আর সেজন্যই ওই পথে হাঁটছেন না তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, অটো ব্রিকস নামে সরাসরি কোনো ইটভাটা নেই। কিন্তু এর দুটি ধরন রয়েছে, একটি ‘হাইব্রিড হফম্যান ভাটা’ এবং অপরটি ‘অটোমেটিক ট্যানেল ক্লিন’ যেটি সনাতন ইটভাটার আপডেট ভার্সন। দুটির ধরনকে একত্রে অটোব্রিকস বলা হয়ে থাকে। এটাকে পরিবেশের ভাষায় বলা হয়, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। সাধারণ ইটভাটার মতোই এই প্রযুক্তি হলেও ইট শুকানো, দূষণহীন পরিবেশ সহায়ক, সীমিত জায়গার ব্যবহার এবং কিছু সহজলভ্য জিনিসের সহায়তায় ইট উৎপাদন সম্ভব বলে জানান অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তির আরেকটি ধরন রয়েছে যেটিকে বলা হয় ‘অটো ব্লক’ যা শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এটি পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত। তাই শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এই ধাপের ইটের আকার বড় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলের সহায়তায় স্বল্প সুদে বড় ধরনের ঋণ সুবিধা নিয়ে উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেখানে সাধারণ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের ওপরে, সেখানে এই খাতে বিনিয়োগ করলে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নামার সুযোগ রয়েছে। এমনকি পরিবেশ ছাড়পত্র পেতেও সহজলভ্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিশ্বব্যাংকের তথ্যনুযায়ী প্রচলিত ইটভাটা থেকে দেশে পরিবেশদূষণ ঘটছে ১৩ শতাংশ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, দূষণের মাত্রা আরো বেশি। এই খাত থেকে পরিবেশদূষণ হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২২৫ হেক্টর ভূমি এবং বছরে ৮২ হাজার হেক্টর ভূমি নষ্ট হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আবাসন তৈরি ও ইটভাটার জন্য মাটি সংগ্রহ করা। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বিশাল সব বহুতল ভবন নির্মাণে কংক্রিট, অ্যালুমিনিয়াম সিট, প্লাস্টিক, কাঁচ, ফাইবার, স্টিল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশসহ বহু স্বল্পোন্নত দেশে প্রধানত ব্যবহার হচ্ছে ইট।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে অধিকাংশ ইটভাটাই মানছে না কোনো নিয়ম, প্রতিনিয়তই নষ্ট করে যাচ্ছে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান : মাটি, বায়ু, কাঠ এবং ওজোন স্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নির্মিত প্রচলিত বা সনাতন পদ্ধতির ইটভাটার সংখ্যা ৬ হাজার ৮৭৬টি। এর মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র অনুযায়ী বৈধ ভাটার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৮৫টি এবং অবৈধ ৩ হাজার ৪৯১টি। গত ৩ বছরে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়েছে ৯২৫টি। এসবের মধ্যে ঢাকা বিভাগে বৈধ ১১৬৩টি ও অবৈধ ৬৬৪টি, রাজশাহীতে ২৫২টি ও অবৈধ ৭৭১টি, বরিশালে ৩৫৯টি ও অবেধ ১৪২টি, সিলেটে ২৬৩টি ও অবৈধ ৩৬টি, খুলনায় ৩০৮টি ও অবৈধ ৭৯০টি, রংপুরে ১৯৪টি ও ৮৪৪টি, ময়মনসিংহে ৮১টি ও অবৈধ ৪৩৪টি এবং চট্টগামে ৭৬৫টি ও অবৈধ ৭৩৫টি। অধিদপ্তরের বাইরে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, যা হিসাবের বাইরে। এটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তাই সরকার এই ইটভাটার বিকল্প অটো ব্রিকস নামকরণ করে প্রথমে জিগজ্যাগ অর্থাৎ হাইব্রিড হফম্যান নামে কম পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটা নির্মাণে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে। এ ধরনের ইটভাটায় চুল্লির নিচে পানির স্তর স্থাপন করে পরিবেশ সহায়ক উপযোগী পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। কয়লা, মাটি বা কাঠ ব্যবহার হলেও যখন ধোঁয়াগুলো কুণ্ডলি হয়ে চুল্লির নিচের স্তর থেকে ওপরের দিকে ধাবিত হয়; পানির স্তর স্পর্শ করে ওপরের দিকে ওঠার কারণে নির্গত ক্ষতিকর কার্বন অনেকটা পরিশোধন হয়ে যায়। এতে পরিবেশদূষণ কিছুটা রোধ হয় বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরেরর পরিদর্শক নয়ন রায়। এখন পর্যন্ত জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে অর্থাৎ হাইব্রিড হফম্যান পদ্ধতির ইটভাটা রয়েছে ৪৭টি। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম রয়েছে খুলনা বিভাগে। এই পদ্ধতিতে ঢাকায় ১৭টি, রাজশাহীতে ৪টি, রংপুরে ৯টি, চট্টগ্রামে ৮টি, ময়মনসিংহে ৭টি, রাজশাহীতে ৪টি এবং ২টি খুলনা বিভাগে। আর সনাতন পদ্ধতিতে চলছে শতভাগ দুটি বিভাগ একটি বরিশাল ও অপরটি সিলেট।
অটোমেটিক ট্যানেল ক্লিন পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনেও আশাব্যঞ্জক কিছু এখনো দেখাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। এই পদ্ধতিতে সুবিধা থাকলেও একটি অটোমেটিক ট্যানেল ক্লিন ইটভাটায় থোক বিনিয়োগ লাগে ৫০ কোটি টাকার ওপরে। বড় পরিসরে করলে তা ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার প্রচলিত একটি ইট এবং অটো পদ্ধতির ইটের দামের তফাৎ মাত্র ৩ থেকে ৪ টাকা হওয়ায় বিনিয়োগ করা ব্যয় উঠতেই সময় লাগবে কয়েক বছর।
এটি শতভাগ না হলেও পরিবেশ সহায়ক। এই পদ্ধতির জন্য যে ধরনের উপাদান প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত না। কারণ কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বাদ পড়া ফ্লাইঅ্যাশ দিয়ে এই প্রযুক্তির ইট উৎপাদন হয়ে থাকে।
কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) ড. মোহাম্মাদ আবদুল মোতালিবের সঙ্গে। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, সনাতন পদ্ধতির ইটভাটায় কাঠ, মাটি ও কয়লা দিয়ে পোড়ানো হলেও ধোঁয়া থেকে পরিবেশদূষণ হয়। আর জিগজ্যাগ পদ্ধতি কিছুটা উন্নত হওয়ায় সেখানে এগুলোর ব্যবহার হলেও কিছুটা পরিবেশবান্ধব। আর অটো ব্রিকসে সুবিধা বেশি, এর মধ্যে দূষিত বায়ুটাকে টেনে নিয়ে কাঁচা ইটের ওপর দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এতে দূষণ কিছুটা কমে।
ড. মোহাম্মাদ আবদুল মোতালিব বলেন, তবে সবাই এই পদ্ধতিতে যেতে চায় না বড় বিনিয়োগের ঝুঁকির কারণে। এক কথায় বললে, বাংলাদেশে আইন আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। তবে ফুল অটো হলে সুবিধা বেশি হতো, তাতে মাটি কম লাগবে ও চিকন বালু ব্যবহার করা যাবে। তখনই এটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে। বায়ুদূষণ থাকবে না।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের অটোমেটিক ট্যানেল ক্লিন পদ্ধতির অটো ব্রিকস কারখানার সংখ্যা মাত্র ৭৬টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৮টি, রাজশাহীতে ৯টি, বরিশালে ২টি, সিলেটে ৩টি, খুলনায় ৬টি, রংপুরে ৪টি, ময়মনসিংহে ৫টি ও চট্টগ্রামে ৯টি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল-মামুন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমাদের প্রচলিত যে ব্রিকসগুলো আছে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ, কয়লা, গাছের গুড়ি ব্যবহার হয়। কিন্তু অটো ব্লকে কোনো জ্বালানি ব্যবহার হয় না। বিদ্যুতের সহায়তায় এটি উৎপাদন করা সম্ভব। আর জ্বালানি না লাগলে তো দূষণ থাকে না এবং দূষিত ধোঁয়া নির্গত হয় না। মৌসুমি ইটভাটাতে কয়লা পোড়ায়, এটি তো সালফার। এটি যখন পোড়ায় তখন সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়, এটি পরিবেশের জন্য খুবই খারাপ। এতে শ্বাস-কষ্ট ও ব্রংঙ্কাইটিস দেখা দেয়।
তিনি বলেন, সনাতন ইটভাটা শুধু নির্দিষ্ট মৌসুমে উৎপাদন হলেও অটো ব্রিকসে সারা বছরই ইট উৎপাদন করা যায়। এই প্রযুক্তিতে আলাদাভাবে ইট শুকানো লাগে না। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা ব্রিকসের যে তাপ থাকে সেটি গ্রিন ব্রিকসের চেম্বারে যায়। গ্রিন ব্রিকসগুলো ওই তাপেই শুকিয়ে যায়। ওই চেম্বারে ডাস্ট বা তাপটি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে পরিবেশদূষণ কমে আসে।
"