শহিদুল ইসলাম সোহাগ, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া)
এমপির থোক বরাদ্দের কাজে এপিএসের অনিয়ম

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) অর্ধকোটি টাকার থোক বরাদ্দে হওয়া ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। কয়েকটি প্রকল্প কাগজে-কলমে থাকলেও এলাকায় ঘুরে কাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ হলেও তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের তদারকির অভাব ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সখ্যর কারণে এই অনিয়ম হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।
এদিকে ‘সময় কম থাকার’ অজুহাতে সব প্রকল্প আর কে ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জিয়াউল কবির সুমন কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সংসদ সদস্য আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্র ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস)।
জানা গেছে, ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী উপ খাতে বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা থেকে কুষ্টিয়া-১ আসনের আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিয়নের উন্নয়নের জন্য ৫০ লাখ টাকা সংসদ সদস্য আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্কে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুকূলে চলতি বছরে ৭ জুন এক স্মারক আদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেট থেকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয় তথ্য অনুযায়ী, সময় কম থাকার কারণ দেখিয়ে রিকোয়েস্ট ফর কোটেশনের (আরএফকিউ) মাধ্যমে চলতি বছরের ৮ জুন ৭টি কোটেশনে ১২টি প্রকল্পের অনুমোদন দেন উপজেলা প্রকৌশলী রাকিব হাসান। ১৫ জুনের কোটেশনের মাধ্যমে সব কাজের দায়িত্ব পায় একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর কে ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জিয়াউল কবির সুমন স্থানীয় সংসদ সদস্য আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস)।
এদিকে প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাতটি কোটেশনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয়টিতে একটি করে প্রকল্প ছিল। পরবর্তী তৃতীয়-সপ্তম কোটেশনটি দুটি করে প্রকল্পে ভাগ করা হয়েছে। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টিকে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফিলিপনগর ইউনিয়নে সর্বোচ্চ চারটি বরাদ্দ পেয়েছে। এ বাইরে মরিচা ও আড়িয়া দুটি করে এবং বোয়ালিয়া, খালিশকুন্ডি, আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নে একটি করে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জিয়াউল কবির সুমনের বাড়ি উপজেলা ফিলিপনগর ইউনিয়নে। প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেছে প্রতিদিনের সংবাদের এই প্রতিবেদক।
প্রথম কোটেশনে উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ গোয়ালগ্রাম জিপিএস থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা ‘হেরিং বোন বন্ড’ (এইচবিবি) করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৬ টাকা। সরকারি কর বাদ দিয়ে চূড়ান্ত বিল হিসেবে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু ওই এলাকায় গিয়ে রাস্তা দূরের কথা, কোনো প্রকল্প ফলকের অস্তিত পাওয়া যায়নি। তবে ওই এলাকায় মাস দুয়েক আগে নতুন একটি রাস্তা হয়েছে। এটি দেখলে মনে হয় বছর দু-এক আগে তৈরি। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ইট উঠে গেছে।
দ্বিতীয় কোটেশনে ছিল উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের ভুরকাপাড়া আশরাফের বাড়ি থেকে ভুরকা গোরস্থান পর্যন্ত এইচবিবি রাস্তাটি। তবে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ১৮ হাজার ২৩৭ টাকা ব্যয়ে একই রাস্তা এইচবিবি হয়েছে। তারপরও ওই রাস্তায় ৪ লাখ ১৫ হাজার ৬৯৬ টাকা বরাদ্দে একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। কর বাদ দিয়ে বিল বাবদ ৩ লাখ ৫১ হাজার ২৬৩ টাকা তোলা হয়েছে।
তৃতীয় কোটেশনটি দুইটি প্রকল্পে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি খলিশাকুন্ডি ইউনিপর খলিশাকুন্ডি গ্রামের জিয়ার বাড়ি থেকে আফজাল মন্ডলের বাড়ি পর্যন্ত। অপরটি আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নের তেকালা গ্রামের জতুব আলী বাড়ি থেকে আহম্মদ আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা। দুুটি রাস্তার প্রস্থ কোথাও পাঁচ ফুট, কোথাও ছয় ফুট। তবে রাস্তায় ব্যবহৃত ইটের নম্বর কত, তার ঠিক নেই বলে জানান স্থানীয়রা। দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭০ টাকা। কর বাদ দিয়ে চূড়ান্ত বিল হিসেবে ৭ লাখ ৪২ হাজার ৬৪৫ টাকা তোলা হয়েছে।
চতুর্থ কোটেশনেও দুটি প্রকল্পে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি প্রকল্প আড়িয়া ইউনিয়নের চর-পাককোলা গ্রামের রেজাউলের বাড়ি থেকে মতলেব ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত। প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী রাস্তাটি দৈর্ঘ্যরে চেয়ে প্রায় ১৫০ ফুটে কাজই করা হয়নি। এ ছাড়া রাস্তার প্রস্থ কোথাও পাঁচ ফুটেরও কম। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, দুদিনের মধ্যেই কোনো রকমে কাজ হয়েছে। নামমাত্র বালি মাটির ওপর ইট বসিয়ে চলে গেছেন শ্রমিকরা। ইটগুলোও দুই-তিন নম্বরের।
আরেক প্রকল্পে আড়িয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিনের পিএস নামে পরিচিত সানাউল্লাহর বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরত্বে তার আরেকটি বাড়ি সাদী হাউস পর্যন্ত রাস্তার কথা উল্লেখ আছে। জানা গেছে, সানাউল্লাহ নিজের খুশিমতো রাস্তা তৈরি করে নিয়েছেন, এজন্য প্রকল্প বিবরণী ফলকের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি সেখানে। ওই দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৪৭ টাকা। কর বাদে তোলা হয়েছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
পঞ্চম কোটেশনে একটি প্রকল্প মরিচা ইউনিয়নের মহির বাজার থেকে পূর্ব বৈরাগীরচর গোরস্থান পর্যন্ত। তথ্য অনুযায়ী ওই এলাকায় গিয়ে কোনো সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। এলাকাবাসী শুরু থেকেই মাটির সড়ক ব্যবহার করছে। আরেকটি প্রকল্পে ফিলিপনগর ইউনিয়নের ফিলিপনগর গ্রামের টোকন প্রিন্সিপালের বাড়ি থেকে পূর্ব বৈরাগীর চর গোরস্থান পর্যন্ত একটি রাস্তার হওয়ার কথা। সেখানেও নিম্নমানের ইট ও বালি দিয়ে কোনো রকমে রাস্তার কাজ শেষ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই দুটি প্রকল্পের বরাদ্দ ৮ লা ৭১ হাজার ৭৫ টাকা। কর বাদে তোলা হয়েছে ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮ টাকা।
ষষ্ঠ কোটেশনের একটি প্রকল্পে ফিলিপনগর ইউনিয়নের কাশেম ঘিওয়ালার বাড়ি থেকে সুসান ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার কাজ কোনো রকমে শেষ করে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অপর প্রকল্পে গোলাবাড়ীর থানচিতলা মোড় থেকে ভেতরের রাস্তার কথা উল্লেখ থাকলেও ঠিকানা অনুযায়ী ওই এলাকায় রাস্তার কোনো কাজের অস্তিত পাওয়া যায়নি সেখানে। প্রকল্প দুটিতে বরাদ্দ ৮ লাখ ২২ হাজার ৩১৪ টাকা। চূড়ান্ত বিল তোলা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৫ টাকা।
এ ছাড়া সপ্তম কোটেশনের একটি প্রকল্পে ফিলিপনগর ইউনিয়নের গনি মাস্টারের বাড়ি থেকে লাটপাড়া ভেতরের রাস্তা হয়েছে। এই রাস্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। অপরদিকে দৌলতপুর সদর ইউনিয়নের দিঘিপাড়া মসজিদ থেকে লালনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার উল্লেখ্য থাকলেও ওই এলাকায় গিয়ে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে দিঘিপাড়া মসজিদের ইমাম আহসানউল্লাহ্ বলেন, ‘আমার মসজিদের কোনো রাস্তা হয়নি।’
সংসদ সদস্যের থোক বরাদ্দের টাকায় হওয়া প্রকল্পগুলো সরেজমিনে তদারকি হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হয় দৌলতপুর উপজেলা প্রকৌশলী রাকিব হাসানের কাছে। তিনি বলেন, ‘দু-একটা জায়গায় নিজে গিয়েছি। বাকিগুলোতে উপসহকারী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম দেখেছেন।’ আবহাওয়াজনিত কারণে প্রকল্প এলাকায় কোনো বিবরণী দেওয়া হয়নি বলে তার দাবি। কাজের অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘মোবাইল আমি কোনো কথা বা বক্তব্য দিতে রাজি নই। আপনি আমার অফিসে দেখা করেন। সামনাসামনি কথা হবে।’ বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
থোক বরাদ্দের টাকায় হওয়া ১২টি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর কে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী জিয়াউল কবির সুমনের কাছে কাজ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘হাতে সময় কম থাকার কারণে আমার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব কাজ করা হয়েছে। সরকারি সব ধরনের কাজ ভ্যাট দিয়েই করা হয়েছে।’
তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৪টি প্রকল্পের কাজ হয়েছে উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়ন। গত রবিবার সন্ধ্যায় ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নৈয়মদ্দিন সেন্টু মোবাইল ফোনে প্রতিদিনের সংবাদ অফিসকে বলেন, ‘ওই কাজ তো এমপির পিএস করেছেন। কাজ মান নিয়ে কথা বললে গলা থাকবে না। দুই নম্বর, তিন নম্বর ইট দিয়ে কাজ হয়েছে, ওই নিয়ে বলে লাভ নেই। আমরা কাজে বাধা দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, গ-গোল করার বয়স না আমার। আপনারা একবার এসে দেখে যান, ওই রাস্তায় চলাচল করা যায় কিনা।’
প্রকল্পের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া-১ আসনে সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদাশাহ্র ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে একটা মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
"