মিজান রহমান ও বদরুল আলম মজুমদার
সংলাপ অনিশ্চিত
যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মুখেও সংলাপের জন্য আশা দেখছে না দেশবাসী। বিএনপি সংলাপ নিয়ে আপাতত চুপচাপ থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোভাব এখনো না। তবে জাতীয় পার্টি সংলাপের জন্য আগ্রহ দেখালেও আওয়ামী লীগের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে দলটিকে। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কী করে তা নিয়েই বাড়ছে অনেকের কৌতূহল। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন, তিনটি দলকে চিঠি দেওয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের মূল চাপ মূলত সরকারের ওপর বর্তায়। বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলন চলমান থাকায় এবং দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কারাগারে। এ কারণে সংলাপের বিষয়ে বিএনপির নেতৃত্বকে নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।
দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সোমবার (১৩ নভেম্বর) জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে ডোনাল্ড লুর চিঠিটি হস্তান্তর করেন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। চিঠিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তহীন সংলাপে বসার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরের দিন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর কাছে পৌঁছানো হয় চিঠি। গতকাল বুধবার (১৫ নভেম্বর) বিকালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে চিঠি পৌঁছে দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সংলাপের আহ্বান সম্পর্কিত চিঠি হাস তুলে দেন ওবায়দুল কাদেরের হাতে। তার চিঠি পেয়ে ওবায়দুল কাদের পরে সাংবাদিকদের বলেন, কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যারা গণতন্ত্র চর্চা করে, তারা সংলাপ চায় না, এমন কথা বলতে পারে না। কিন্তু একটা সময় আছে। আজকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হচ্ছে। আপনি সংলাপ করবেন কবে। তখন সাংবাদিকরা জানতে চান, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের সুযোগ আছে কিনা জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এখন আর সংলাপের কোনো সুযোগ নেই। তবে চিঠির বিষয়টি নিয়ে তিনি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করবেন বলে জানান।
সংলাপ নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহমান। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সংলাপ তো অতীতে হয়েছে। সেসব সংলাপের অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। বরং তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারপরও আমাদের দল বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে সংলাপ করবে কি করবে না। তবে সোমবার (১৩ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন বার্তার পর মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে সরকারের আপত্তি নেই। তবে কার সঙ্গে সংলাপ হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. মোমেন। অবশ্য বন্ধু দেশ কোনো পরামর্শ দিলে সরকার তা মূল্যায়ন করে বলেও জানান মন্ত্রী।
গতকাল বুধবারও পিটার হাস সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সে সময় তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। হাস বলেন, ‘আমরা এ কথা বারবারই বলে এসেছি যে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে নেই। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনের জন্য শর্তহীন সংলাপে বসার জন্য আমরা সব পক্ষের কাছে আহ্বান জানাই।’
এদিকে বিএনপি সংলাপে বসবে কিনা জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, সংলাপ কে করবে বা কাকে নিয়ে আমরা সংলাপ করব? দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে রয়েছেন। অন্যদের পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। দলের প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাহলে সংলাপটা কে করবে, কীভাবে করবে? দলটির স্থায়ী কমিটি নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সংলাপে বসা না বসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান এই বিএনপি নেতা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংলাপের বিষয়ে তো আমি একা সিদ্ধান্ত নেব না। এটা দলগত সিদ্ধান্তের বিষয়। সংলাপের বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
দলের বিদেশবিষয়ক উইংয়ের সিনিয়র এই সদস্য মনে করেন, সংলাপ আয়োজন বা ডাকার মূল দায়িত্ব সরকারের। সেদিক থেকে সংলাপের আহ্বান সরকারের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। একাধিক বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা জানান, ডোনাল্ড লুর চিঠি গতানুগতিক। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে কোনো কোনো নেতা মনে করছেন এর বিপরীত, বিশেষত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রক্রিয়াটি নির্বাচন কমিশনের ওপরও চাপ বাড়াচ্ছে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘সংলাপে যাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। সারা দেশ এখন অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহতভাবে চলছে। বিশেষ করে বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গ্রেপ্তার-আটক চলছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির মহাসচিব, সিনিয়র নেতারা বন্দি রয়েছেন কারাগারে। ফলে সংলাপের আগে অফিস অবমুক্ত করা, নেতাকর্মীদের মুক্তি এসব প্রণিধানযোগ্য। এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকেই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। সংলাপের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চান জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় জাতীয় পার্টি এখনো মনে করে সংলাপের সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সবাইকে চিঠি দিয়েছে, তাই আমরা আশা করছি বিএনপিও সংলাপে অংশ নেবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, লুর চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান। সংলাপ ছাড়া নির্বাচনে গেলে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
সংলাপের বিষয়ে জাতীয় পার্টিও মহাসচিব মুজিবুল হকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সংলাপ চাই। আমি দলের পক্ষ থেকে, এমনকি একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও বলেছি শর্তহীন সংলাপে বসার জন্য। যারা বলে শর্ত আছে, তাদের শর্ত নিয়ে টেবিলে আসতে বলার জন্যও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।’
"