মিজান রহমান
আওয়ামী লীগে নির্বাচনের প্রস্তুতি
দেড় শতাধিক আসনে গ্রিন সিগন্যাল শিগগিরই
তরুণ, সৎ, নিবেদিতপ্রাণ ও জনপ্রিয় নেতারা পাবেন মনোনয়ন * কপাল পুড়তে পারে শতাধিক সংসদ সদস্যের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক তোড়জোড় না থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এবার ক্ষমতাসীন দলটি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় চায় না। তাদের লক্ষ্য অংশগ্রহণমূলক ভোট। সে লক্ষ্যেই চলছে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আগামী সপ্তাহ থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। পাশাপাশি প্রায় ১৬০ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গ্রিন সিগন্যাল দেবেন- যাতে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সংকট তৈরি না হয়।
জানা গেছে, এবার প্রার্থীদের দুটি তালিকা তৈরি করবে আওয়ামী লীগ। একটি ব্যবহার করা হবে বিএনপি নির্বাচনে এলে এবং অন্যটি বিএনপি না এলে। এছাড়া শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিও নির্ভর করবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্তের ওপর। বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ৩০০ ডামি প্রার্থীর তালিকা করারও প্রস্তুতি আছে ক্ষমতাসীন দলটিতে। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি এড়াতে এটি করা হবে। সেসময় আওয়ামী লীগের ১৫৪ প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে অক্টোবর মাসে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। প্রার্থীদের মৌখিকভাবে এলাকায় কাজ করার নিদের্শনা দেওয়া হবে। তবে এখনই লিখিত কোনো কাগজ পাবেন না প্রার্থীরা। তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত প্রার্থীদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং দলের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে কারা মনোনয়ন পাবেন, তা নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চলতি মাসে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন যতক্ষণ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের (মনোনীত প্রার্থী) অফিশিয়াল চিঠি দেওয়া হবে না। তবে নির্বাচনী মাঠে কাজ করার জন্য সিগন্যাল দেওয়া হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন। অনেকে নিজের প্রার্থিতা জানান দিয়ে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। আয়োজন করছেন নানা অনুষ্ঠান, অংশগ্রহণ করছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মসজিদের খুতবায়ও বক্তব্য দিচ্ছেন। পাশাপাশি দলের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র পোস্টার, ব্যানার ও লিফলেটের মাধ্যমে এলাকায় প্রচার করছেন।
জানা গেছে, বিগত সময়ে বর্তমান সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী মাঠে না থাকলেও এখন নিজ এলাকায় বেশি সময় দিচ্ছেন। চালাচ্ছেন সাংগঠনিক তৎপরতা। তবে নিজ দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠছাড়া করতে অনেকে কলকাঠি নাড়ছেন বলে দলের হাইকমান্ডের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কেউ কেউ। দলীয় সূত্র মতে, বিগত সময়ে যে ফরম্যাটে মনোনয়ন দেওয়া হতো, এবারও সেভাবে দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তফসিল ঘোষণার পর দলীয় ফরম বিক্রি শুরু করবে। সেই ফরমগুলো হাতে আসার পর জরিপের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।
বাদ পড়তে পারেন শতাধিক এমপি : আওয়ামী লীগের ২৬১ সংসদ সদস্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ শতাধিক সংসদ সদস্য তাদের অপকর্ম ও ক্রমবর্ধমান অজনপ্রিয়তার কারণে মনোনয়ন নাও পেতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের পৃষ্ঠপোষকতা, ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা এবং দলীয় নেতাদের উপেক্ষা করে নিজের গ্রুপের পক্ষে অবস্থান নেওয়া তাদের বিতর্কিত হওয়ার মূল কারণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও উত্তরাঞ্চলের সংসদ সদস্যরা অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে দলীয় আনুকূল্য বেশি হারিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে বিতর্কিতদের পরিবর্তে তরুণ, জনপ্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ নেতারা দলীয় টিকিট পাবেন। দলের সেবা করার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সাবেক সংসদ সদস্যরাও মনোনয়ন পাবেন। সূত্রগুলো দাবি করেছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তা জানতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দলের তৃণমূল ও জনগণের ওপর বেশ কয়েকটি জরিপ চালায় এবং প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১০০ বর্তমান সংসদ সদস্য তৃণমূলের সমর্থন হারিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও দলীয় কমিটিতে নেতা মনোনয়নে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব, টেন্ডারবাজি, টাকার বিনিময়ে মানুষকে চাকরি দেওয়া এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে প্রত্যেক আসনে তিনজন বিকল্প প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা এবং সাবেক সংসদ সদস্য রয়েছেন। সূত্র জানায়, একটি জরিপ চলছে এবং বিএনপি কোন পথে যায়, তা দেখার পর আরেকটি জরিপ করা হবে। চূড়ান্ত জরিপ প্রতিবেদন দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের সামনে উপস্থাপন করা হবে- যাতে তারা মনোনীত প্রার্থীদের তারা চূড়ান্ত করতে পারে।
দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্রতি আসনে আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী নিশ্চিত করা দলের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও উদ্বেগের বিষয়। কারণ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৪ হাজার ৩৭ জন আওয়ামী লীগের টিকিটপ্রত্যাশী ছিলেন এবং পরে দলটিকে প্রায় ৩০০ আসনেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে দশম জাতীয় সংসদের ৫৬ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী দলের মনোনয়ন পাননি। এর আগে একইভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৪৯ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ৪ হাজার ২৭টি ইউপি চেয়ারম্যান পদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা পেয়েছেন ২ হাজার ১৭২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ১ হাজার ৭৭৮টি। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আইনপ্রণেতাদের একটি অংশের পতনের বিষয়ে তারা অবগত আছেন। আমরা তাদের পরিবর্তে তরুণ, সৎ, নিবেদিতপ্রাণ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেব। এবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাই হবে প্রধান মাপকাঠি।
"