গাজী শাহনেওয়াজ
আইনের ফাঁদে আটকা পোস্টাল ব্যালটে ভোট

এবারও আইনি ফাঁদে আটকে গেল পোস্টাল ব্যালটে ভোটদান কার্যক্রম। এ জটিলতা কাটাতে দরকার ছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ (আরপিও) সংশোধন। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় আপাতত আরপিও সংশোধনের সুযোগ মিলছে না। ফলে আসন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত দেশ-বিদেশে থাকা কোটি নাগরিক।
পোস্টাল ব্যালটে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক নাগরিকের মধ্যে রয়েছেন নির্বাচনের কাজে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশীয় সাংবাদিক, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও প্রবাসে থাকা কোটি নাগরিক। আরব আমিরাতসহ প্রায় ৪০টি দেশে প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচে পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে এসব নাগরিকের স্বপ্ন থেকে যাচ্ছে অধরা।
বর্তমান আরপিও বিধান অনুযায়ী, ভোটগ্রহণের দিনই ফল প্রকাশ করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে ফল পাঠান নির্বাচন কমিশনে। তবে পোস্টাল ব্যালটে ভোট হলে নির্ধারিত সময়ে ভোটদাতাদের মতামত ইসিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এটি ডাকযোগে পাঠাতে হয়। আসতেও কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে। তাই পোস্টাল ব্যালটের সিদ্ধান্তের জন্য ফল আটকে রাখা হলে তুলকালামও ঘটে যেতে পারে। তাই আরপিও সংশোধন ছাড়া এ প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে কমিশনে আলোচনা হলেও ফল শূন্য।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পোস্টাল ব্যালটে ভোট নেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু প্রবাসী নাগরিক নন; দেশের অনেকেই নির্বাচনী কাজে ভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারাও ভোটদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ আরপিওতে পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানে যে বিধান বলা আছে, সে অনুযায়ী কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখনো তফসিল ঘোষণা হয়নি, তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
এ প্রসঙ্গে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের বিষয়ে কমিশনে আলোচনা উঠেছিল। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সেটি কভার করে না, বিধায় সিদ্ধান্তটি আলোচনা পর্যায়ে থেমে যায়। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোট আয়োজন করতে চাইলে অবশ্যই আরপিওতে সংশোধনী আনতে হবে। অন্যথায় আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। কারণ পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার পর সেটি আসতেও বিলম্ব হয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত নির্বাচনী ফল আটকে রাখা সম্ভব নয়। তাই আপাতত এ পদ্ধতিতে ভোট প্রক্রিয়ার চিন্তা কমিশনের নেই বলে জানান প্রশাসন সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ এ কর্মকর্তা।
ইসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশন পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থাটি সংস্কার ও কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এজন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও বিধি সংশোধনের কাজেও হাত দিয়েছিল তারা। ওই কমিশন চেয়েছিল আরপিও সংশোধন করে পোস্টাল ব্যালটের ব্যালট অনলাইনে দিতে। এক্ষেত্রে নাগরিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় প্রতীক বরাদ্দের পর অনলাইনে ব্যালটপেপার দেওয়া থাকবে। সেখান থেকে কোনো নাগরিক একবারই সেটি ডাউনলোড করতে পারবেন। কারণ একজনের জন্য একটিমাত্র নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে একটিমাত্র ব্যালটপেপারই অনলাইনে সরবরাহ করা হবে। অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু হুদা কমিশন সেটি কার্যকর করে রেখে যেতে পারেনি।
বর্তমান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে আরপিওর কিছু ধারায় সংশোধন, কিছু ধারা সংযোজন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পথ প্রশস্ত করেছে। এরই মধ্যে তাদের সংশোধিত আইনটি সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু যেই বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্বাচনী কাজে যুক্ত, যার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ এবং প্রবাসে থাকা রেমিট্যান্সযোদ্ধা রয়েছেন আরো ১ কোটি। সব মিলিয়ে সোয়া কোটির মতো মানুষ পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিটি যুগোপযোগী না হওয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে দূরে থাকছেন। আরপিও সংশোধনের সময় এ ধারায় সংশোধনী আনা হলে ওইসংখ্যক মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু যখন কমিশন এ উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় বসে, তখন আইন সংশোধনের মতো পর্যান্ত সময় তাদের হাতে ছিল না। ফলে তাদের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে থেমে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে ইসির। কিন্তু এত বছরেও পোস্টাল ব্যালটে কখনো ভোট নেওয়া হয়েছে কিনা, সে তথ্য কেউ জানাতে পারেনি। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী ভোটদান থেকে দূরে থাকছেন বছরের পর বছর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান আরপিও অনুযায়ী বাংলাদেশি ভোটাররা দুভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। একটি হচ্ছে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে সরাসরি ভোটদান; অন্যটি পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটদান। পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ১৫ দিনের মধ্যে ভোটারকে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালটপেপারের জন্য আবেদন করতে হয়। পরবর্তী সময়ে প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার পর পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ব্যালটপেপার পৌঁছানো হয়। এরপর ভোট দিয়ে সিলগালা করে সেটি আবার পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে হয়। এ প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে তা কার্যকর নয় বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা।
এ অবস্থায় পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা আরো সহজ করা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার নৈতিক অধিকার রয়েছে। তারা কীভাবে ভোটটি দিতে পারেন, সেটির বাস্তবায়ন করতে নির্বাচনী কর্তৃপক্ষকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। আইন সংশোধন করে করবেন নাকি কোন পদ্ধতিতে করবেন, সে সিদ্ধান্ত তাদের। নাগরিক ভোটটি দিতে পারল কিনা, সেটিই দেখার বিষয়। যেভাবেই হোক, পোস্টাল ব্যালটের বিধানটি কার্যকর করা দরকার। যেকোনো নির্বাচনে একটি ভোটও একজন প্রার্থীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা অবশ্যই কার্যকর করা দরকার। কারণ আইনি জটিলতার দোহাই দিয়ে কাউকে অবহেলা করা সঠিক পদ্ধতি বলে আমি মনে করি না। কারণ এটি কার্যকর না হওয়ায় বিশাল জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সংবিধানেও ভোটারযোগ্য নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। তাই এ ব্যবস্থা কার্যকর করে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দেশে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রবাসেই ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা চেয়েছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৭ সালে ১৮ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রীকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন তিনি, যার কপি তৎকালীন সিইসির কাছেও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এটিও চালু করা যায়নি। বিগত কমিশন যেটা পারেনি; ওই পথেই হাঁটছে বর্তমান কমিশনও। ফলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে প্রতিবারের মতো এবারও ভোটদান থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে কমিশনের সদিচ্ছার অভাবে।
"