গাজী শাহনেওয়াজ
চালু হচ্ছে নির্বাচনী অ্যাপ ব্যয় ২০ কোটি টাকা
ঘরে বসে অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে মনোনয়নপত্র * প্রবেশাধিকার থাকবে ৭ শ্রেণির ব্যক্তির * থাকবে ৪ ধরনের সুবিধা
যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীদের অনলাইনে (ঘরে বসে) মনোনয়নপত্র পাঠানোর জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ। চলতি মাস সেপ্টেম্বরের শেষদিকে অথবা আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বহুমুখী সুবিধা-সংবলিত এই অ্যাপ তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে ২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে সফটওয়্যারের পেছনে ৯ কোটি ১১ লাখ এবং হার্ডওয়ারের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
প্রস্তুত হওয়া অ্যাপটির আদ্যপান্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনাররা, কমিশন সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে অবহিত করবেন নেপথ্যের কারিগররা। এর আগে ট্রায়াল বেইস পর্যবেক্ষণ চালানো হবে।
নির্বাচক কমিশন সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ অথবা অক্টোবরের প্রথমদিকে অ্যাপটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে পুরোদমে। বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাৎসরিক বরাদ্দ রাখা হবে, যাতে সার্বক্ষণিক এটি সচল থাকে। কারণ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটির কারণে প্রায় ৪০ হাজার যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো সংস্কারে ব্যয় হয়েছে অনেক টাকা। বর্তমানে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের কারণে তা কমিশনের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, অ্যাপটি তৈরির পেছনে সরকারের খরচ হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এই অর্থ হার্ডওয়ার ও সফটওয়্যারের পেছনে ব্যয় হবে। বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা ব্যয় নির্ধারিত থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই অ্যাপে বিশেষ ধরনের চারটি সুবিধা রাখা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, যেকোনো নির্বাচনে ঘরে বসে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। ভোটাররা তার এই অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারবেন তার ভোটকেন্দ্র কোনটি; জানতে পারবেন কোন পথ দিয়ে কেন্দ্রে পৌঁছাবেন তার পথনির্দেশনা। এ ছাড়া নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তারা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর কতগুলো ভোট পড়ল, তার একটি পরিসংখ্যান বা হিসাব দেখতে পারবেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচনগুলো হয়, তার বিস্তারিত তথ্য যেমন, কবে নির্বাচনটি হয়েছিল, ভোটার কতজন ছিল এবং নির্বাচনের মেয়াদ কবে শেষ হবে, এসব বিষয়ও জানা যাবে এই অ্যাপের মাধ্যমে।
ইসির সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপে কয়েক ধরনের ব্যক্তির প্রবেশাধিকার থাকবে। যাদের মধ্যে থাকবেন ভোটার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সচিব ও কমিশন সংশ্লিষ্টরা। অ্যাপে যেসব সুবিধা থাকার বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- নির্বাচনী এলাকার নাম ও নম্বর; প্রার্থীর নাম, পরিচিতি, ছবি, দলীয় পরিচয় ও মার্কা, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য; ভোটকেন্দ্র-সংক্রান্ত তথ্য (কেন্দ্রের নাম ও কেন্দ্রের নম্বর); কেন্দ্র ও ভোটারের তথ্য (ভোটাররা যাতে অ্যাপে দেখতে পারেন, তিনি কোন কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন); কোন কোন আসন-ভোটকেন্দ্রে ইভিএম এবং কোন কোন আসন-ভোটকেন্দ্রে ব্যালট ভোট হবে; কেন্দ্র ও আসনভিত্তিক মোট ভোটার সংখ্যা (পুরুষ ও নারী); নির্বাচন শেষে আসন-কেন্দ্রভিত্তিক কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন, তা সংখ্যায় ও চার্টের মাধ্যমে প্রদর্শন; দলভিত্তিক প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ও নিকটতম প্রার্থীর পরিচিতি এবং প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা।
বিশেষ ক্ষেত্রে এই অ্যাপে শুধু কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও কমিশনের প্রবেশাধিকার থাকবে। এই অ্যাপে রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ডিসি, এসপি ও ওসিসহ দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের পরিচয় ও ফোন নম্বর ইত্যাদি থাকবে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ইসির আইটি বিভাগ ঘরে বসে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল-সংক্রান্ত অ্যাপটি নিয়ে কাজ করছে। অ্যাপ তৈরি সম্পন্ন হলে সেটি সিইসি ও কমিশনারদের সামনে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে। তাদের সম্মতি মিললে চলতি মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপটির কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে। তবে এটির ক্ষেত্রে বিশেষ চারটি সুবিধা থাকবে।
ইসির তথ্যমতে, অলনাইনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে। এর আগে ঢাকা-১৭ আসনে সীমিত পরিসরে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধান রেখেছিল ইসি; যা ছিল টেস্ট কেস। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান নির্বাচনী বিধিমালায় সংযুক্ত করা হয়। দশম সংসদ নির্বাচনে এই সুযোগ থাকলেও তা কার্যকর ছিল না। সেটি পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক ছিল না। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সেটির কাগজপত্রও (হার্ড কপি) রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হয়। এখন বিষয়টি পুরোপুরি অনলাইননির্ভর হতে যাওয়ায় ওই ঝামেলা শেষ হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা করার আগে প্রার্থী নিজে অথবা অন্যের সাহায্যে এ কাজটি করতে পারবেন। প্রথমে প্রার্থীকে ইসির ওয়েবসাইটে ঢুকতে হবে। অনলাইনে মনোনয়নপত্র অপশনে গিয়ে প্রার্থী রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করবেন। এরপর একটি ইউজার আইডি পাবেন সংশ্লিষ্ট প্রার্থী। সেটিকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে প্রার্থী নিজে মুখমন্ডল অ্যাপে ‘শো’ করবেন। সঙ্গে ভোটার তথ্যভান্ডারে যাবতীয় তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট ছকে বসে যাবে। এরপর ধাপে ধাপে আয়কর রিটার্ন, হলফনামা, দলীয় প্রার্থী হলে স্বাক্ষরিত সত্যায়িত কপিসহ আনুষঙ্গিক তথ্য আপলোড করবেন। প্রতিটি ধাপের তথ্য সেভ অপশনে চাপলে সেটি সংরক্ষিত হবে। পরবর্তীতে নতুন তথ্য সন্নিবেশ করলে আগের তথ্য হুবহু থাকবে। প্রার্থীর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর প্রস্তাবকের মুখমন্ডলের ছবি ও তার তথ্য আপলোড করবেন। এরপর শেষ ধাপে সমর্থকের তথ্য সংযোজনের পর প্রার্থী, প্রস্তাবক ও সমর্থকের ছবি ক্রসম্যাচিংয়ের পর সেটি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠালে ফিরতি এসএমএস পাবেন নিজ মোবাইলে। এভাবেই নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছ থেকে এসএমএসের মাধ্যমে অবহিত হবে প্রার্থীতায় তিনি টিকেছেন নাকি বাতিল হয়েছে। তবে, প্রার্থী অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও প্রার্থীতা যাচাই-বাছাইয়ের সময় উপস্থিত থাকতে হবে সরাসরি। এ ছাড়া প্রার্থী বিবাহিত না অবিবাহিত তাও তথ্য সংযোজন করতে হবে।
আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর-সংবলিত প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার ছবি আপলোড করতে হবে। তবে হার্ডকপি বার্তা বাহকের মাধ্যমে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছালেই কাজ শেষ হবে। আর আগে প্রার্থীর হলফনামা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত থেকে স্বাক্ষর করলেও এখন আগে স্বাক্ষর করানো হলফনামা আপলোড করলেই মনোনয়নপত্র বৈধ হবে।
এদিকে, প্রার্থীদের জামানতের টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারবেন প্রার্থী। প্রার্থীর জামানত ২০ হাজার টাকা।
"