জাহিদুল ইসলাম
নিত্যপণ্যে সিন্ডিকেট
দেশের মানুষ কষ্টে আছে

সম্প্রতি সারা দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। হাসপাতালে আসতে থাকেন ডেঙ্গু রোগী। এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কারণে বেড়ে গেছে স্যালাইন ও ডাবের দাম। যে স্যালাইন (শিরায় ব্যবহৃত) য়ীল ৮৭ টাকা, সেটা সাড়ে ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও যে ডাব ৪০-৫০ টাকা বিক্রি হতো রাতারাতি সেই ডাবের দাম হয়ে গেছে ১২০-১৩০ টাকা। এমনকি ৩০০ টাকায়ও একটি ডাব বিক্রি হতে দেখা গেছে। দেশে এমন সব ঘটনার পেছনে যে বিষয়টি বার বার উঠে আসে তা হলো ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট’। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে এমন দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
সচেতন মহলের মতে, ডলার সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের যে প্রভাব পড়ার কথা, তার চেয়েও পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ। তারা বলছেন, বৈশি^ক প্রভাব সব দেশেই পড়েছে কিন্তু অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক।
সম্প্রতি ডাব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা। সেখানে ডাব ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডাবের দাম ২৫-৩০ টাকা। সেগুলো মাত্র ৮-১০ টাকা লাভে বিক্রি হয় জেলা পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে। এরপর সেখান থেকে ঢাকার ডাব ব্যবসায়ীরা প্রতিটি ডাব গড়ে ৫০-৬০ টাকায় কিনে আনলেও ঢাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সেই ডাব হয়ে যায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ইতিমধ্যেই দেশে আলুর দাম ৫০ টাকা পেরিয়ে গেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকার ও হিমাগারের মালিকরা বাজারে চাহিদামতো যোগান না দিয়ে মজুদ করছেন। অপরপক্ষে হিমাগার মালিকরা বলছেন, কৃষকরা আলুর চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। তাই হিমাগারে আলু বেশি আসে না। সরকারি হিসাবে আলু সংরক্ষণের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সঠিক নয়। আলুর সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বাড়তি।
গতবছর লবনের দাম নিয়েও হয়েয়ীল কারসাজি। ঈদের আগে বেড়েয়ীল মসলার দাম। বর্তমানে চিনির দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। সিন্ডিকেটের হাত ধরে গত মার্চে এক হালি লেবু এক’শ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। কিছুদিন আগেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িয়েছে সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট ও অন্যান্য পণ্যের দাম। এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য বেড়েছে। লোডশেডিংকে পুঁজি করে ১৫’শ টাকার চার্জার ফ্যানও সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এমনকি সিন্ডিকেটের কারণে গরুর মাংসের দামও আকাশচুম্বি। এক তথ্যে দেখা যায়, পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় এক কেজি গরুর মাংসের দাম ১৭৫ রুপি বা বাংলাদেশী ২২৪ টাকার মতো। পাকিস্তানে প্রতি কেজি ৬০০ রুপি, যা বাংলাদেশী ২৩০ টাকার সমান। নেপালে প্রতি কেজি ০.৭৬ মার্কিন ডলার বা ৮০ টাকা, ভুটানে ১৬০ নুল বা ২০৭ টাকা এবং মিয়ানমারে ৫.৬৬ মার্কিন ডলার বা ৫৬৭ টাকা। অথচ বাংলাদেশে গরুর মাংস ৮০০ টাকা কেজি। রাজধানীর কোন কোন এলাকায় ৮৮০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়।
মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতা দ্রব্যমূল্যে বেশি প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. মাসুম মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলার সংকটের প্রভাবে যদি সব জিনিসের দাম বাড়ে তাহলে ডাবের দাম বাড়লো কোন প্রভাবে? এটা আমদানি করতে হয় না। কেন বাড়লো ইলিশের দাম? এটাও তো আমদানি করয়ী না। এছাড়া ইলিশ মাছকে খাবার খাওয়াতে হয়না। তিনি বলেন, এখন বিদেশে শ্রমিক গেলেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যেতে হয়। শুধু এই কারণে মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠাতে এখন দ্বিগুনেরও বেশি খরচ বেড়েছে।
শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার কয়েকদিন আগে একটি গণমাধ্যমে এই অসাধু চক্রের বিষয়ে তথ্য তুলে ধরে নিজের জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সিন্ডিকেট যারা নিয়ন্ত্রণ করবে তাদেরই সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার কথা। এমনকি বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও চলতি অর্থবছরের বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরেন এবং অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, বড় গ্রুপগুলোই একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। জেলে ভরলাম জরিমানা করলামণ্ড সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে যে সংকট তৈরি হয়, সেটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু সিন্ডিকেটের কারণেই দ্রব্যমূল্য এমন ঊর্ধ্বমুখী, সেটা মনে করেন না কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর মহাসচিব গোলাম রহমান। তার কাছে এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয়। এই প্রবণতা সিন্ডিকেটের চেয়েও ভয়াবহ। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দুনিয়াজুড়েই একটা ইনফ্লেশন য়ীল। কোভিডের সময় বিভিন্ন ধরনের প্রব্লেম দেখা দিয়েছে, প্রডাকশন কমে গিয়েছে। সেজন্যই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর হওয়ায় বহির্বিশে^র ইনফ্লেশনের প্রভাব দেশে পড়েছে। আবার এক্সচেঞ্জ রেটও এর জন্য দায়ী। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিয়ম হার কমে গেছে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে ইনফ্লেশন কমে জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পেলেও তার প্রভাব দেশে পড়ছে না।
পাশাপাশি ইনফ্লেশন কন্ট্রোল করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। গোলাম রহমান বলেন, ইনফ্লেশন কন্ট্রোল করার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নীতিনির্ধারকরা যে পলিসি নিয়েছে বাংলাদেশে তা নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণের দায়ীত্ব কেন্দ্রীয় ব্যংকের। ইনফ্লেশন বেড়ে গেলে ইন্টারেস্ট রেট বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে ইন্টারেস্ট রেট ৯ এবং ৬ শতাংশ ঠিক করে দিয়েছে সরকার। সে কারণে ইন্টারেস্ট রেট মেনিপুলেশন করে কন্ট্রোল করার যে মেকানিজম তা আমাদের দেশে নেই। আমরা এটা অনুসরণ করয়ী না, বরং বিপরীতটা করয়ী। অবশ্য কিছুদিন আগে আইএমএফের কারণে এই রেটটা ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু এখনও তা মার্কেট বেইজড ইন্টারেস্ট রেটে আসেনি।
তবে প্রধান কারণ হলো ঘাটতি অর্থায়ন। এ বছরের বাজেটে ডেফিসিট আছে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ডেফিসিট ফাইন্যান্সিংয়ে একটা উপায় হলো সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে সরকারের টাকা ধার নেয়া। সেন্ট্রাল ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিচ্ছে, ফলে মানি সার্কুলেশন বেড়ে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে সরকার প্রায় ৯৯ হাজার কোটি টাকা সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন ৯৯ হাজার কোটি টাকা মানে হলো মার্কেটে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি পাওয়া। যখন মানি সার্কুলেশন বাড়ে তখন ইনফ্লেশন বেড়ে যায়।
এছাড়া মূল্যবৃদ্ধির অন্যান্য কারণের মধ্যে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতাও অন্যতম বলে মনে করেন তিনি। ক্যাব সভাপতি বলেন, এটা শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সবাই করছে। যেহেতু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। বিভিন্ন পণ্যের বিপণন বা আমদানিতে একটা অলিগপলিস্টিক সিচুয়েশন আছে। অলিগপলিস্টিকে যদি একজন দাম বাড়িয়ে দেয় অন্যরা তা অনুসরণ করে। এটা সারাদেশে হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে এক শ্রেণীর পকেট দিনের পর দিন ভারী হবে। অন্যদিকে অপর এক শ্রেণী নগদ ও পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে। এতে আয় বৈষম্য বাড়ছে। এর ফলে মানুষের মৌলিক অধিকার কতটুক নিশ্চয়তা পাবে। কারণ, খাদ্যের ব্যবস্থা করতে গেলে শিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে না, চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে না। এমন প্রশ্নে ক্যাব সভাপতি বলেন, আয় বৈষম্য যে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। মানুষের জীবন মানে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আপনি যা বলেছেন সবই সঠিক। দরিদ্র মানুষরা এখন স্কুল থেকে বাচ্চাদের ছাড়িয়ে এনে কাজেকর্মে লাগিয়ে দিচ্ছে। মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা আমাদের দেশে কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আপনি কি বলতে পারবেন, দেশের সবার জন্য বাসস্থান, সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মৌলিক অধিকারের কথা আমরা বলি কিন্তু মৌলিক অধিকার পেতে গেলে যে স্টেইজ অব ডেভলপমেন্টের দরকার সেই স্টেইজ অব ডেভেলপমেন্টে আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিতে পারছে না জানতে চাইলে প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছে না, কারণ, তাদের কোন ইচ্ছা নাই। তাহলে মৌলিক অধিকার রক্ষা করে কীভাবে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে সরকার জনমনে স্বস্তি আনতে পারবে। এমন প্রশ্নে বলেন, সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে। আমাদের কোন পরামর্শ কেউ গ্রহণ করে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে মানুষ বর্তমানে দুঃখে আছে, কষ্টে আছে।
"