গাজী শাহনেওয়াজ
পূবালী ব্যাংকে সশস্ত্র গার্ডদের কাজ করানো হয় ১৮ ঘণ্টা
দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সময়সীমার নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই পূবালী ব্যাংকের সশস্ত্র প্রহরীদের (আর্মড গার্ড)। ৮ ঘণ্টা ডিউটি করার নিয়ম থাকলেও তাদের দিয়ে টানা ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। সাপ্তাহিক ছুটিও মেলে না তাদের। আবার অতিরিক্ত সময় কাজ করানো হলেও তারা কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধাই পান না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সশস্ত্র প্রহরীদের ৮ ঘণ্টার ডিউটি শুধু নামেই, যা চাকরির ক্ষেত্রে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত খাটুনির কারণে প্রহরীরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারো কারো ভেঙে গেছে সংসার। এসব দিকে কর্তৃপক্ষের নজর নেই বলে অভিযোগের পাহাড় জমেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে শাখা ম্যানেজার ও প্রহরীদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। দীর্ঘসময় টানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক প্রহরী হারিয়ে ফেলছেন মেজাজ। এক শাখা ব্যবস্থাপকের ওপর ক্ষুব্ধ প্রহরীর চড়াও হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর এটি ঘটেছে সিলেটের কানাইঘাট শাখায়। সেখানে কর্তব্যরত সশস্ত্র প্রহরী মহসীন আলী ত্যক্তবিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের ওপর চড়াও হন। উভয়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে বলে শাখা ব্যবস্থাপকের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে। এ নিয়ে ওই গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে, যা চলমান। সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে অপ্রীতিকর ঘটনা আরো ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কা অন্য প্রহরীদের।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, সশস্ত্র প্রহরীদের ক্ষেত্রে মানা হয় না শ্রম আইনের নীতি। চাকরিবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে পদে পদে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, বিশ্রামের জন্য বিরতি সংক্রান্ত ১০১-এর (ক-গ) ধারায় বলা আছে, ‘একজন শ্রমিককে ছয় ঘণ্টার অধিক কাজ করিতে বাধ্য থাকিবেন না, যদি না উক্ত দিনে তাহাকে বিশ্রাম বা আহারের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়; দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক কাজ করিতে বাধ্য থাকিবেন না, যদি না উক্ত দিনে উক্ত উদ্দেশ্যে তাহাকে আধা ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়, অথবা দৈনিক আট ঘণ্টার অধিক কাজ করিতে বাধ্য থাকিবেন না, যদি না উক্ত দিনে উক্ত উদ্দেশ্যে তাহাকে দফা (ক) এর অধীন একটি বিরতি অথবা দফা (খ) এর অধীন দুইটি বিরতি দেওয়া হয়।’ আর সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা সংক্রান্ত ১০২ এর (১) ধারায় বলা আছে, ‘কোন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানে সাধারণত সপ্তাহে আটচল্লিশ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করিবেন না বা তাহাকে দিয়ে কাজ করানো যাইবে না; তবে শর্ত থাকে যে কোন বৎসরে উহা গড়ে প্রতি সপ্তাহে ছাপান্ন ঘণ্টার অধিক হইবে না।’
পূবালী ব্যাংক টাঙ্গাইল জেলা সড়ক শাখার সিনিয়র আর্মড গার্ড আবদুল আলিম মির্জার এক অভিযোগ থেকে জানা যায়, চলতি বছর এপ্রিলের ৫ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত তাকে দিয়ে টানা দায়িত্ব পালন করানো হয়। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এ গার্ড। ওষুধ আনার জন্য শাখা সংলগ্ন হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তাকে তলব করে বসেন শাখা ম্যানেজার। চাকরি হারানোর ভয়ে ওষুধ না নিয়েই শাখায় ফিরে আসেন তিনি। এরপরও কর্তৃপক্ষের শাস্তির খড়গের মধ্যে পড়তে হয় তাকে। শুধু আলিম মির্জা একা নন; দেশজুড়ে বিস্তৃত সব শাখার গার্ডদের চিত্র অভিন্ন। কারণ এটা নতুন নয়, সবসময় তাদের দিয়ে এভাবেই ডিউটি করাতে বাধ্য করানো হয়।
পূর্বালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সুনজরে আনতে দুটি শ্রমিক সংগঠন ইতোমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। সংগঠন দুটি হচ্ছে- এমপ্লয়িজন ইউনিয়ন (সিবিএ)-৯৪১ ও পূবালী ব্যাংক কার্মচারী সংঘ-১৭৮৩। তাদের দাবি, সশস্ত্র প্রহরীদের ডিউটি ৮ ঘণ্টা নিশ্চিত করা। এসব সংগঠনের দাবি কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গার্ড তাদের দুঃখ ও কষ্টের কথা স্বীকার করেন। প্রতিদিনের সংবাদকে তারা বলেন, শ্রমিক সংগঠন দুটি তাদের ৮ ঘণ্টার ডিউটি নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা, দেনদরবার ও চিঠি চালাচালি অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। এতে সশস্ত্র প্রহরীদের মধ্যে বাড়ছে হাতাশা। তারা ক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ।
অপর একজন গার্ড পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কথা বলেন। তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পূবালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের লজ্জা-শরম নেই। গার্ডদের দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করায়। অহেতুক আমাদের (গার্ড) হয়রানি করা হয়। প্রহসনমূলক বদলি করে এবং মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে শাস্তি দেয়া হয়। তিনি বলেন, অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। অনেক গার্ড এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে শাখা ম্যানেজারদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন। বলেছেন, দ্রুত কর্তৃপক্ষ আশু সমাধানে ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
অপর একজন অভিযোগে বলেন, পূবালী ব্যাংকের আর্মড গার্ডদের ২৪ ঘণ্টা ডিউটি- এটা কোনো ম্যানেজার স্বীকার করতে চান না। কিন্তু ডিউটি রেজিস্ট্রার ও গার্ডের সংখ্যা যাচাই করে দেখলেই গার্ডদের ২৪ ঘণ্টা ডিউটির সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের দিয়ে ম্যানেজাররা দিনের পর দিন বিরতিহীন ডিউটি করতে বাধ্য করেন। যদি এতে অপরগতা কেউ দেখান, তাহলে দূরে বদলি এমনকি চাকরি হারানোর হুমকি দেয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের নির্বিচার ডিউটি করানো ও ছুটি না পাওয়া নিয়ে নিজস্ব আর্মড গার্ডদের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের টানাপড়েন অব্যাহত আছে। আর্মড গার্ডরা বলেন, আমাদের দাবি ৮ ঘণ্টা ডিউটি নিদিষ্ট করা এবং সাপ্তাহিক ছুটি নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে ছুটির দিনে ডিউটি করলে তার জন্য বাড়তি পারিশ্রমিক প্রদান করা। আরেকজন বলেন, আমাদের এসব দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পূবালী ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন শ্রম অধিদপ্তরের পরিদর্শক। কেস নং-৩২৫৯২/২০।
এদিকে বেশিরভাগ শাখায় মেসেঞ্জার কাম গার্ডকে দিয়ে নিরাপত্তা ডিউটি করানো ছাড়াও হেল্পার/পিয়নের কাজ করানো হয়। আর্মড গার্ড ছুটিতে গেলে ডিউটির জন্য অন্য কাউকে পাওয়া যায় না। পূবালী ব্যাংক ১৯৫৯ সাল থেকেই আর্মড গার্ড নিয়োগ করে আসছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অপরাধে ইতোমধ্যে কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে পূর্বালী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম মো. শাহীন খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সশস্ত্র প্রহরীদের আমরা ৮ ঘণ্টাই ডিউটি করাই। কিন্তু কারো সুনিদিষ্ট অভিযোগ থাকলে কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে বলেন। কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হলে অনেকের চাকরি চলে যায়- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সরাসরি নাকচ করেন। বলেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে চাকরি গেছে।
"