জাহিদুল ইসলাম

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মামলা-জরিমানা সত্ত্বেও ভাঙছে না সিন্ডিকেট

‘মাছ-মাংস খামু কইথিক্যা, চাউল-ত্যালই তো কিনবার পারি না। সরকারে সব জিনিসের দাম বাড়াইছে। আমগোরে দেখবো কেডায়, আমরা খামু কী’- রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে কাছে টিসিবির ট্রাক সেল পয়েন্টের লাইনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নূরবানু। লাইনে তার সামনে চল্লিশেক মানুষ। বয়সের তুলনায় ন্যুব্জ শরীরটা নিয়ে রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। পাশেই একটি ব্যাংকের বুথের ছায়ায় বসলেন। জানালেন পরিবারের কথা।

ছেলে-ছেলের বউ ও তিন নাতি-নাতনি নিয়ে নূরবানু থাকেন কমলাপুর রেলওয়ে কলোনির পাশের বস্তিতে। ছেলে রিকশা চালান আর ছেলের বউ করে ঝিয়ের কাজ করেন। বড় নাতনি ঘরের কাজ সামলালেও ছোট দুই নাতি এখনো কোনো কাজ করে না। ছয় সদস্যের এই পরিবারে মূলত আয়ের উৎস ছেলে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকেল থেকে রাত ১১ অবধি রিকশা চালিয়ে যে আয় হয় তা অপ্রতুল। ছয় সদস্যের পরিবারের খরচ আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সব জিনিসের দামে ঊর্ধ্বগতি।

বাজারে এখন মোটা চালও কেজিপ্রতি ৫২-৫৫ টাকা। খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৩০ টাকা, মোটা দানার ডাল ১০০ টাকা, আলু ৫২ টাকা, শাকসবজি ৬০-৮০ টাকা, পেঁয়াজ ৭০-৭৫ টাকা, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ১৬০ টাকা। শুধু খাবার খরচেই চলে যায় দিনে সাড়ে ৫০০-৬০০ টাকা। এরপর রয়েছে ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের ভাড়া, ওষুধ ও ডাক্তার খরচ। জামা-কাপড়ের কথা নাইবা বললাম। ঈদের সময় এলকার জনপ্রতিনিধিদের থেকে দুটি কাপড় পেয়েছিলেন। পরনের ছেঁড়া মলিন কাপড় দেখিয়ে জানালেন, অনেক দিন থেকেই পরনের একটা কাপড় দরকার। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, ছেলেকে সে কথা বলতেও পারছেন না। মৌলিক অধিকারের যে দাবি, সেখানে অন্ন কোনো রকমে জুটলেও বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা যেন স্বপ্ন।

শুধু নূরবানু নন এমন পরিস্থিতি দেশের প্রায় সব মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির। সরকারি চাকরি করেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য চাল, তেল, চিনি, আদা, কাঁচামরিচ, ডিম, পেঁয়াজ, মুরগি, মাছসহ সব জিনিসের দাম নাগালের বাইরে।

দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে ব্যবসায়ীরা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও পণ্য সরবরাহ সংকটকে দায়ী করলেও সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজ তা পুরোপুরি মানতে নারাজ। তারা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক সমস্যা। এর প্রভাব সব দেশেই পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অন্যান্য দেশে চিনি, তেলসহ পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। এজন্য তারা সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সরকারের তথ্য মতে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করে মূলত দাম বাড়াচ্ছে বড় একটি চক্র।

সম্প্রতি ডিমের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে একটি তদন্ত চালায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। এতে দেখা যায়, পরস্পর যোগসাজশে ডিমের দাম বৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে কতিপয় ব্যবসায়ী। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে সংস্থাটি। প্রাপ্ত তথ্যে, এসব কোম্পানি ও তাদের সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলো এসএমএসের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি মুনাফা করে ভোক্তা সাধারণের পকেট কেটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ছয় কোম্পানি ও চার বাণিজ্যিক সমিতির বিরুদ্ধে মামলা করার পদক্ষেপ নিচ্ছে সংস্থাটি। এগুলো হলো- ইউনাইটেড এগ, কাজী ফার্মস লিমিটেড, প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড, পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, নাবা ফার্ম লিমিটেড, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিআইএ), বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ ও পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ (পিপিবি)।

এক সাক্ষাৎকারে বিসিসির চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তদন্তে বেশ কিছু কোম্পানি ও তাদের সংশ্লিষ্ট সমিতির যোগসাজশে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি মুনাফার আদায়ের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

অবশ্য উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডিমের বাজারে অস্থিরতার কারণে সিপি, প্যারাগন, কাজী, ডায়মন্ড এগসহ তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আমানত উল্লাহর বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও মামলা করেছিল বিসিসি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কারসাজিতে জড়িয়ে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ উঠল প্যারাগন, কাজী ও ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের বিরুদ্ধে।

করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তর কেন পুরোপুরি ব্যবস্থা নিতে পারছে না এমন প্রশ্নে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, স্যালাইনের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের একটা মিটিং হয়েছে। ৮৭ টাকার স্যালাইন ৩৫০ টাকা হয়েছে। এই দাম কি করপোরেটরা বাড়িয়েছে? এটা বাড়িয়েছে ফার্মেসিগুলো। আর করপোরেট যাদের কথা বললেন তাদের নিয়ে কাজ করে আমরা সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছি। এখন প্রতিযোগিতা কমিশনের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং শুনানি পর্যায়ে আছে। গত বছরের মামলাগুলোর রায় খুব শিগগিরই আসবে। তবে এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন ভালো বলতে পারবে। আমরা সরকারকে তথ্য দিয়েছি বলেই সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে।

গত বছর যাদের নামে মামলা হয়েছে এ বছরও তারা একই কাজ করায় ফের মামলা হলো। বারবার তারা এই কাজ করার দুঃসাহস কীভাবে পাচ্ছে, এর জবাবে বলেন, এর উত্তর আমি না, প্রতিযোগিতা কমিশন দিতে পারবে। তিনি বলেন, ব্রয়লার মুরগি, ডিম নিয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করেছি। তাদের জিজ্ঞাসা করুন কী ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়া মজুদদারীর বিষয়ে কঠিন আইন আছে, তাদের বিশেষ ক্ষমতাও আছে। আইনে আমাদের যতটুকু ক্ষমতা আছে ততটুকুই করতে পারব, এর বেশি তো পারব না।

ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে দাম কমে, অভিযান বন্ধ হলে দাম বাড়ে- এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান কীভাবে, এমন প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, স্থায়ী সমাধান করতে গেলে সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনার যে ট্রেডিশনাল সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনার সার্বিক যে সরবরাহ ব্যবস্থা তা তো আমি প্রতিষ্ঠা করতে পারব না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close