বদরুল আলম মজুমদার

  ০৯ জুন, ২০২৩

খালেদা জিয়ার মুক্তির গুঞ্জন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে সংলাপ। সরকারি দলের নেতারা এরই মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব এবং যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে বিএনপি সরকারের এ প্রস্তাবকে আগের মতো কালক্ষেপণ বা কৌশল বলেই মনে করছে। দলটির নেতারা সংলাপের জন্য এজেন্ডা দেওয়ার কথা বলছেন। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়কের স্পষ্ট এজেন্ডা থাকলেই কেবল সংলাপ হতে পারে বলে জানিয়েছে বিএনপি। এদিকে বিএনপি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের মাঝে বরফ গলাতে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়টি সামনে আসছে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন পক্ষ কাজ করছে বলে জোর আলোচনা আছে।

জানা গেছে, গত দুদিনে সরকারি দলের উচ্চপর্যায়ের কমপক্ষে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ কিংবা আলোচনার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের কঠোর মনোভাব, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং পর্দার অন্তরালে চলমান নানা তৎপরতার মধ্যেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে এমন বক্তব্য নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। তবে সংলাপের ‘অভিজ্ঞতা তিক্ত’ হওয়ায় বিএনপি এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে আগ্রহী নয়। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে- এমন ঘোষণা এলেই তারা কেবল সংলাপে বসবেন, এর আগে নয়।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন- এমন গুঞ্জনও রাজনীতির ময়দানে চাউর হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে, বেগম জিয়ার মুক্তির আলোচনা তারই অংশ বলে কেউ কেউ মনে করছেন। যদিও এ বিষয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) বিকেলে দলের এক নেতা বলেন, ‘যে কোনো কিছুই হতে পারে।’

বেগম জিয়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের একবছর আগে কারাবন্দি হন। প্রায় ২ বছর কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি শর্তযুক্ত সাময়িক মুক্তি পান। মুক্তির পর ৬ মাস অন্তর অন্তর কারাগারের বদলে তার বাসায় থাকার মেয়াদ বাড়ছে। শারীরিক নানা জটিলতা থাকলেও বেগম জিয়া এখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ আছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলতি বছরের মার্চ থেকে পুরোদমে আন্দোলনের মাঠে নামে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সরকারবিরোধী আরো বেশ কয়েকটি জোট। দলটির নানামুখী আন্দোলন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত ২৪ মে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর ঢাকায় কূটনৈতিকপাড়ায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ আরো বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বেড়ে যায় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতাও।

ভিসানীতি ঘোষণার পরের দিন গত ২৫ মে গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে একত্রে বৈঠক করেন। জানা যায়, ওই বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সব দলের সংলাপ আয়োজন ছাড়া সমাধানের পথ দেখছি না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সে কথাই বলেছেন।

এরপর সিরিজ বৈঠক হয়েছে। গত রবিবার পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন পিটার হাস। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি উপস্থিত ছিলেন। একই দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তা পিটার হাসকে অবহিত করেন দলের মহাসচিব। মির্জা ফখরুল এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলে তারা মনে করেন। এ বক্তব্যই তিনি তুলে ধরেন পিটার হাসের কাছে। এ ছাড়া বৈঠকে সংলাপ নিয়ে বিএনপির অবস্থানও মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করা হয় বলে দলের সূত্রে জানা গেছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন তৎপরতার মধ্যে গত মঙ্গলবার ১৪ দলের এক সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বিএনপির এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আমরা তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংলাপ করতে চাই। তবে বুধবার (৭ জুন) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করতে হবে- এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব- এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব।

অন্যদিকে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সংলাপের মাধ্যমে সবকিছু সমাধান হতে পারে। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’

গত ৮ মে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতিসংঘ যে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে, সেকথা উল্লেখ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও বিশ্বসংস্থাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন দলটির নেতারা। এ সময় তারা বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতিসংঘের তৎকালীন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

তারানকো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। তবে সংকট নিরসনে তিনি সফল হননি। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, নির্বাচনে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই, প্রার্থীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, গায়েবি মামলা দিয়ে নির্বাচনী মাঠ ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার সরকারের সঙ্গে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যেতে আগ্রহী নয়।

সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোথায় কোন সমাবেশে কে কী বলছেন- সেটার জবাব দেওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করছি। আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেওয়ার জন্য ভাববো।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দলের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, সরকার যদি চায় যে সংঘাত এড়িয়ে সামনের দিকে যাবে, তাহলে প্রথম কাজটা করতে হবে বিরোধী দলগুলোর দাবি পূরণ করা। অর্থাৎ সরকারকে পদত্যাগ করে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যদি বলে আমরা পদত্যাগ করব, তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে কথা বলব, তাহলে হয়ে যাবে। সরকার পদত্যাগ না করে সংলাপ আহ্বান করলে তাতে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে অথবা ঘোষণা দিতে হবে যে তারা পদত্যাগ করবে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও সংকট নিরসনে পর্দার অন্তরালে সংলাপ চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close