মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ২৫ মে, ২০২৩

শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ডা. ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

যশোরের শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগপত্র দায়ের করেছেন অফিস সহায়ক রওশনারা। হাসপাতালের ৯ জন মেডিকেল অফিসারসহ ১৩২ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেছেন। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে তারা দাবি করেছেন, ডা. ইউসুফ আলী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করেন। নির্দেশ দেন যার যার দপ্তর নিজ খরচে চালাতে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাওনা ঠিকমতো দেন না, বিভিন্নভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেন।’ তার তিন বছর চাকরিকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারী তার ওপর অসন্তুষ্ট। তাই এমন কর্মকর্তার বদলিসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে এ ডাক্তার বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

অফিস সহায়ক রওশনারা স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রটি গত ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক, খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, যশোর সিভিল সার্জন, দুদক, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ এপ্রিল যশোর সিভিল সার্জন বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি টিম তদন্ত করেছে। এছাড়া গত ৩ মে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মনজুরুল মুরশিদ তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করেছেন। তদন্ত কমিটিতে আছেন প্রধান সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) খুলনা, মো. আক্তারুজ্জামান, সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রক) খুলনা অপর্ণা বিশ্বাস ও হেড ক্লার্ক মাসুম আহম্মেদ।

ডা. ইউসুফ আলী ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এ হাসপাতালে যোগদানের পর পরই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এসিআর ফরমে স্বাক্ষর বাবদ ৫ হাজার টাকা করে প্রতি বছর সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে আদায় করেছেন। বহির্বিভাগের ৩ টাকার টি০িকট ১০ টাকা করেছেন, বেডে ভর্তি বাবদ ৮ টাকার স্থলে ২০ টাকা করেছেন। হাসপাতালের বেডে স্বল্প সংখ্যক রোগী থাকলেও প্রতিদিন বেশি রোগী ভর্তি দেখিয়ে তিন বারের খাওয়ার টাকা ও নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহে তার হাত রয়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত টেস্টব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অবৈধ চুক্তিতে বিভিন্ন ক্লিনিকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন। ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ১০/১২ হাজার টাকা বেতনে মাস্টাররোলে কিছু কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তাদের মাসে দেন ৫/৬ হাজার টাকা। বেতন কম পাওয়ার প্রতিবাদ করলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি করোনা ক্যাম্পেইনে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও তিনজন স্বেচ্ছাসেবীকে ১৭০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দিয়েছেন ৫০০ টাকা। নিলাম ছাড়াই পুরাতন অ্যাম্বুলেন্স ও বিভিন্ন ম্যাশিনারি যন্ত্রপাতি স্থানীয় কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালের চত্বরে ল্যাম্পপোস্টের খুঁটি মেরামত করে নতুন খুঁটি কেনার বিল উত্তোলন করেছেন। পুরাতন কোয়ার্টারের পরিত্যক্ত গ্রীল দিয়ে ফুলবাগানের বেষ্টনী গ্রীল নির্মাণ করে নতুন গ্রীলের বিল উত্তোলন করেছেন। এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যশোর শহরের ডালমিলের বিপরীতে আপন নিবাস নামে একটি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন ও যশোর শহরে ২টি স্থানে জমি কেনার জন্য বায়নানামা করেছেন বলে সূত্র জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্র্যাককর্মী জানান, করোনার টিকা পুশ করার জন্য ব্র্যাকের অর্থায়নে প্রতিদিন ৫০০ টাকা সম্মানী হিসাবে ৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৫০ টাকা হারে তাদের সম্মানী দিয়ে অবশিষ্ট টাকা মেরে দিয়েছেন এ মেডিকেল কর্মকর্তা। এছাড়া যশোরের এনজিও ‘হিডো’-এর সুমাইয়া আক্তার, সাবিকুন্নাহার, খুশি, সম্রাট, সোহেলী আক্তার রিতু ও মিরা- এ ৬ জন সদস্য নিয়োগ দিয়ে শার্শা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠালে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলী পাঁচজনের কাছ থেকে ৫ লাখ এবং সোহেলী আক্তার রিতুর কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে তারা জানিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, এ ৬ জনের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ৮ হাজার টাকা উল্লেখ থাকলেও তাদের বেতন দেওয়া হয় ৬ হাজার টাকা করে। সুমাইয়া ও খুশি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলীকে টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। অভিযোগকারী রওশনারা বলেন, ‘শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলী আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। আমাদের বাজেট, টিএডিএ, পোশাক ও ট্রেনিং-এর কোনো টাকা দেন না। টাকা চাইলে অপমান করেন। তাই লিখিত অভিযোগ করেছি সব দপ্তরে। আমরা তার অপসারণ দাবি করছি।’

শার্শা উপজেলা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার আবু তাহের বলেন, ‘অফিস সহায়ক রওশনারার অভিযোগগুলো আমাদের কাছে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় আমরা শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলীর অপসারণ দাবি করে গণস্বাক্ষর করেছি। তিনি আমাদের লোকজনের সামনে অপমান করেছেন।’ তবে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমি পূর্বে জ্ঞাত ছিলাম না। যখন জানতে পেরেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে- সেসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে।’

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। খুলনা বিভাগীয় তদন্ত টিম তদন্ত করে গেছে। আমাদেরও তদন্ত টিম তদন্ত চালাচ্ছে।

খুলনা বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রধান সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘‘ শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের করা হচ্ছে। সরে জমিনে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা সবার কাছ থেকে লিখিত নিয়েছি। তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলেই আমরা রিপোর্ট জমা দিব।

সর্বশেষ গত রোববার যশোর সিভিল সার্জন অফিসের তদন্ত টিম শার্শা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সম্পন্ন করেন। যশোর সিভিল সার্জন অফিসের তদন্ত টিমের সভাপতি ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাক্তার নাজমুস সাদিক রাসেল, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান, মেডিকেল অফিসার ডাক্তার রেহেনা নেওয়াজ ও অভয়নগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার ওয়াহেদুজ্জামান সঙ্গে ছিলেন। তদন্ত কমিটির সভাপতি ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাক্তার নাজমুস সাদিক রাসেল বলেন, আমরা তদন্ত করেছি। তদন্ত রিপোর্ট জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close