নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ মার্চ, ২০২৩

খেজুরের বাজারে জালিয়াতি ৩৮ শতাংশ কর ফাঁকি

মাহে রমজানে ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। সে কারণেই রমজান মাসে দেশে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। এবার রমজান মাসকে পুঁজি করে খেজুরের বাজারে ভয়ংকর জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেজি প্রতি আমদানি মূল্য সর্বোচ্চ ৯০ টাকা হলেও ব্যবসায়ীরা বাজারে বিক্রি করছেন ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তিন পদ্ধতিতে খেজুর বাছাই করে ভোক্তার পকেট কাটছেন ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারকেও দিচ্ছেন রাজস্ব ফাঁকি। এর সত্যতাও পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয়েছে চট্টগ্রামের তিন আমদানিকারককে।

জানা গেছে, রমজানে ২৮ ধরনের খেজুর আমদানি হলেও কাস্টমস শুল্কায়নে সব খেজুরের মান নিম্ন এবং দাম এক। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হয়। তবে বন্দর থেকে খালাসের পরই পাল্টে যায় চিত্র। উন্নত, মাঝারি ও নিম্ন তিনটি ক্যাটাগরিতে বিক্রি করে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশে বেশি বিক্রি হয় আমিরাত গোল্ড নামের খেজুর। এটির দাম জাহিদি জাতের খেজুরের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। নাগাল, রেজিস, দাব্বাস ও লুলু জাতের খেজুরও আসে আমিরাত থেকে। দুবাইয়ের লুলু, মদিনার মাশরুক, মরিয়ম, কালমি, সাফাওয়িসহ ২৮ রকমের খেজুর দেশে আসে। ইরাকের জাহিদি খেজুরের চেয়ে ৩ থেকে ২০গুণ বেশি দাম মিসরের মেজডুলের। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানিকারকরা সব খেজুরের দাম এক ঘোষণায় এনে উচ্চ হারে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন। কোনো খেজুরের দাম ১০০ টাকা হলে কাস্টমসে তার শুল্কায়ন হবে আমদানি মূল্যের ওপর। এক্ষেত্রে ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক হার নির্ধারিত রয়েছে। এখন ৩০০ টাকার পণ্যও ১০০ টাকা ঘোষণা করা হলে শুল্ক হারে কোনো পরিবর্তন আসে না। মাঝে শুল্ক বঞ্চিত হয় সরকার।

এদিকে, শনিবার (২৫ মার্চ) নগরীর ফলমণ্ডিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম ও প্রতীক দত্ত অভিযানে গিয়ে আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখার প্রমাণ পান। এ সময় আল্লার রহমত স্টোরকে ৫০ হাজার, আলী জেনারেল ট্রেডিংকে ১০ হাজার ও ফ্রেশ ফ্রুট গ্যালারিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

তৌহিদুল জানান, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪০ হাজার ২৪ টন খেজুর আমদানি করা হয়েছে, যার গড় মূল্য পড়েছে ৮৯ দশমিক ৩৬ টাকা। কিন্তু ফলমণ্ডির আমদানিকারকরা কয়েকগুণ বেশি দামে বিভিন্ন মানের খেজুর বিক্রি করছিলেন।

অভিযানে দেখা যায়, রহমত স্টোর ২৫৭২ টন খেজুর আমদানি করে ৭০ দশমিক ১৪ টাকা দরে। কিন্তু ৩ থেকে চারগুণ বেশি দামে বিক্রি করছিল। তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অপর আমদানিকারক আলী জেনারেল ট্রেডিং ১৬৮ টন খেজুর আমদানি করে গড়ে ১০৪ টাকায়। কিন্তু বিক্রি করছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা খেজুর ফ্রেশ ফ্রুট গ্যালারি চট্টগ্রামে কয়েকগুণ দরে বিক্রি করছিল। তাদের ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বাজার ঘুরে জানা গেছে, সবচেয়ে দামি খেজুর সৌদি আরবের ‘মেডজুল’। এটা দুই রকমের আছে বাজারে। আকারে বড়, প্রায় দেড় থেকে ২ ইঞ্চি লম্বা ‘জাম্বো মেডজুল’ নামে পরিচিত এই খেজুরের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। গত বছর ছিল ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি। সাধারণ মেডজুল এবার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৮০০ টাকা। এরপর রয়েছে সৌদি আরবের ‘মাবরুম’ ও ‘আজওয়া’। ভালো মানের মাবরুম খেজুরের দাম ১ হাজার টাকা কেজি। একটু নিম্নমানের মাবরুম কেনা যাবে ৯০০ টাকায়। ভালো মানের আজওয়ার দামও ১ হাজার টাকা কেজি, তবে সর্বনিম্ন পাওয়া যাবে ৮০০ টাকায়।

আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ১৩১ টন খেজুর এসেছে, প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ৮০ টাকা ২০ পয়সা। আগের মাসে ৯২ টাকা ৯১ পয়সা দরে আসে ৭ হাজার ৬৮২ টন খেজুর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানির তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, এ সময় দেশে ৫০ হাজার ২৫৭ টন খেজুর এসেছে। ৪৭৭ কোটি ২৮ লাখ টাকায় আনা এসব খেজুরের দাম পড়েছে কেজিতে গড়ে ৯৪ টাকা ৯৬ পয়সা। চলতি অর্থবছরে ২৮ ধরনের খেজুর এলেও সবগুলো একটি এইচএস কোড (পণ্য শনাক্তকরণ নম্বর) মূলে শুল্কায়ন করেছেন আমদানিকারকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি মার্চে দাম আরও কমে যাওয়ায় এখন সব খেজুরের গড় মূল্য দেখা যাচ্ছে ৮৯ টাকা ৩৬ পয়সা। কিন্তু বাজারে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে খেজুর। এ হিসাবে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, খেজুরের বাজারে ভয়ংকর জালিয়াতি চলছে। উচ্চমূল্যের খেজুর নিম্নদামের ঘোষণা দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করছেন কিছু আমদানিকারক। এর মাধ্যমে তারা সরকারকেও রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। ৩ পদ্ধতিতে খেজুর বাছাই করে ভোক্তার পকেট কাটছেন ব্যবসায়ীরা। দাম কারসাজিতে সিরাজুল ও নুরের যোগসাজশ মিলেছে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রামের আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘অ্যারাবিয়ান ফ্রুটস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তার দোকানে বেশি দামে খেজুর বিক্রির প্রমাণ পেয়েছি। তারা ২৫ থেকে ২৮ ধরনের ৯ হাজার ২১১ টন খেজুর আনলেও সব কটি একটি এইচএস কোডের বিপরীতে শুল্কায়ন করেছে। প্রতি কেজি খেজুরের আমদানি মূল্য মাত্র ৮৪ দশমিক ৬৪ টাকা হলেও সিরাজুল ইসলামের দোকানে হাজার টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close