শাহিদ আবেদীন

  ২৪ মার্চ, ২০২৩

হঠাৎ কূটনৈতিকপাড়ায় রাজনৈতিক দৌড়ঝাঁপ

কূটনীতিকদের দেওয়া ভোজসভায় যোগদান * স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা * প্রাধান্য পেয়েছে নির্বাচন-তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ

দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। সভা-সমাবেশের পাশাপাশি কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা ঢাকায় কূটনৈতিকপাড়ায় যোগাযোগ রাখছেন। কূটনীতিকদের দেওয়া ভোজসভায় যোগ নিচ্ছেন; তাদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন।

এদিকে কূটনৈতিকপাড়ায় হঠাৎ রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। বুধবার (২২ মার্চ) সকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। পিটার হাসের বাসভবনে এ মধ্যাহ্নভোজে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মি আহমেদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ এ আরাফাত।

সেখানে দুই পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আলোচনায় ছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাউন্সিলর স্কট ব্রেন্ডন, রাজনৈতিক শাখা প্রধান আর্তুরো হাইনস, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের সুশাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ের টিম লিডার মেধাউই গিরি এবং মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা মেথিউ বেহ।

বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি বিষয়ে তুলে ধরেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চান।

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের এক সদস্য বলেন, ‘বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এবং দলটির সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপ হয়েছে কি না- পিটার হাস তা জানতে চান। তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাকে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছিলেন। গতবারও বৈঠক হয়েছিল কিন্তু মাঝপথে এসে তারা নির্বাচন থেকে সরে গেছে। নির্বাচন শেষ হতে দেয়নি এবং ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করেনি। কেউ যখন মাঝপথ থেকে উঠে যাবে তখন তো অন্যদল ফাঁকা মাঠেই গোল দেবে।’

আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সূত্র জানায়, বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎ হয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়- এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী।

জবাবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তাদেরই আন্দোলনের ফসল। কিন্তু বিএনপি ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অপব্যবহার করেছে। এর ফলেই এক/এগারোর মতো অনির্বাচিত সরকার এসেছে। এখন পাকিস্তান ছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্বে এ ধরনের সরকারের অস্তিত্ব নেই। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে যাবে না, এটা পরিষ্কার। তবে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক নেতা বলেন, ‘আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছি বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করিয়েছে। তারা আইনি ও আর্থিকভাবে পুরোপুরি স্বাধীন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। এ ছাড়া অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো যে সুষ্ঠু হয়েছে- সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকেই বেশি শুনতে চেয়েছেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তারা প্রত্যাশা করেন।

এ বিষয়ে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলে এসেছি, এদেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে না। বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়কের ভূত ভুলে যেতে হবে।

এদিকে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গেও আলোচনা করেছে তারা।

আগামী নির্বাচন ও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ১২ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে করে বিএনপির নেতারা। গুলশানের এবিসি হাউসে এ বৈঠকে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রতিনিধি দলে আরো ছিলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ ও মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান। অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চালর্স হোয়াইটির নেতৃত্বে বৈঠকে ছিলেন ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, জার্মানি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতরা।

আমীর খসরু জানান, দেশের মানুষ যেভাবে দেশের অবস্থা ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে, একইভাবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বৈঠকে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কী আলাপ হয়েছে জানতে চাইলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এখানে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে একটা অবৈধ সরকার ক্ষমতায় বসে আছে, এ প্রেক্ষাপটেই আলোচনা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যদি দেশের মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে তাহলে বাংলাদেশ যে সংকটের দিকে যাবে এ শঙ্কা দেশের ভেতরে যেভাবে কাজ করছে, দেশের বাইরেও কাজ করছে। এ শঙ্কা থেকেই তারা জানতে চাচ্ছে, কীভাবে আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে, কীভাবে এটাকে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করা যায়। সবার উদ্দেশ্য, একটি নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ হবে, নির্বাচিত সরকার হবে।

কূটনৈতিকপাড়ায় হঠাৎ রাজনৈতিক দলের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক কাদির কল্লোল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা মূলত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভোজসভায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কি? নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে বিএনপির দাবির বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলটির মনোভাব কী- তাও জানতে চেয়েছে। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী সেসব জানতেই মূলত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ ভোজসভার আয়োজন করেছেন। দলটির নেতারা সেখানে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন।

তিনি আরো বলেন, বিএনপি নেতারাও মূলত নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close