কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২৪ মার্চ, ২০২৩

খাতুনগঞ্জে পণ্য পর্যাপ্ত তবু বাড়তি দাম

রোজার শুরুতে বাজার অস্থির * তেল চিনি খেজুরসহ সবকিছুর মূল্য চড়া

প্রচুর আমদানি, পর্যাপ্ত পণ্য, তারপরও বাড়ছে দাম। রমজানের শুরুতেই নানা অজুহাতে অস্থির হয়ে উঠেছে খাতুনগঞ্জ বাজার। এখান থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে ভোগ্যপণ্য। ফলে খুচরা বাজারে আরেক দফা দাম বাড়ছে। ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। পেঁয়াজে সয়লাব হলেও কোনো না কোনো গুজবে কয়েক দিন ধরে অল্প অল্প করে বাড়ানো হচ্ছে দাম। রোজা শুরুর দিকে নাগালের মধ্যে শুধু ছোলার দামটা রয়েছে। তারপরও গত বছরের তুলনায় বেশি। আর চিনির দামে অস্থিরতার কারণে সরকার ভ্যাট কমিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, চিনির দামও চড়া।

বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) খাতুনগঞ্জ ছিল বেশ রমরমা। শত শত ট্রাক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। উঠানো হচ্ছে পণ্য, যাবে নানা জেলায়। তিন মাস ধরে চলছে পণ্য আমদানি ও মজুদ। চাহিদা ও জোগান সমানতালে চলছে; কোনো ঘাটতি নেই। তবু দামের ক্ষেত্রে এসবের কোনো কিছুর প্রভাব পড়ছে না বললেই চলে। রমজানে সবচেয়ে বেশি থাকে চিনির চাহিদা। এবার চিনি আগের চেয়েও মজুদ বেশি। সরকারও চিনির চাহিদার প্রতি নজর রেখে ভ্যাট কমিয়েছে। কিন্তু চিনির বাজারে ভ্যাট কমানোর কোনো প্রতিফলন নেই। নানা অজুহাতে দাম বাড়ছে। রমজান শুরু হওয়ার পরপরই নানা অজুহাতে প্রতি কেজিতে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে কমপক্ষে ৫ টাকা। বৃহস্পতিবার রমজান শুরুর আগের দিন খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি মণ চিনির দাম ৪ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ১০ দিন আগেও বাজারে চিনির পাইকারি মূল্য ছিল ৩ হাজার ৭৫০ টাকা। চট্টগ্রামের চৌমুহনী বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি সাদা চিনির দাম ঠেকেছে ১১৫ থেকে ১১৮ টাকায়, যা গত সপ্তাহেই ছিল ১০৪ টাকা। লাল চিনি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি কেজির দাম উঠেছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।

কাস্টমস সূত্র জানায়, প্রতি বছর দেশে চিনির চাহিদা থাকে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে প্রয়োজন পড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ টন চিনির। রমজান সামনে রেখে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার টন। আর পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টন। বিপুল চিনি মজুদ থাকলেও বাজারে চিনি নেই, গুজব ছড়িয়ে বাড়ছে চিনির দাম।

হঠাৎ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে আদা। গত ১০ দিন খুচরা বাজারে যে আদার দাম ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, সেই আদা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়! ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে আদার সংকট আছে। চীন থেকে আগে আদা আসতো; এখন আসছে না। থাইল্যান্ড আর মিয়ানমারের আদার ওপর নির্ভরশীল বাজার। দেশের বাজারে প্রতি কেজি মিয়ানমারের আদা ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহেই ৭৫ টাকা ছিল। আর থাইল্যান্ডের আদার দাম গত সপ্তাহ থেকে কিছুটা কমে হয়েছে ১৮০ টাকা। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি আদার দাম ছিল ১২০ টাকা।

রমজানে সয়াবিন তেলের চাহিদা থাকে বেশি। চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে ২ লিটার তেলের দাম ৩৮০ টাকা। এক লিটার তেলের দাম ১৯০ টাকা। ফেব্রুয়ারিতে প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম ছিল সাড়ে ৬ হাজার টাকা। রোজা শুরুর সাথে সাথে দাম ৬ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৬ হাজার ৭০০ টাকায় ওঠানামা হচ্ছে।

কয়েক দিন আগে ভারতে ১০ টাকায় পেঁয়াজের বাজার নামায় কৃষকরা আন্দোলন করেছিল। বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ায় পেঁয়াজের বাজারে ধস নামে। আর বাংলাদেশে সেই পেঁয়াজ ৩০ টাকায় নিয়ে যাওয়ার ফন্দি-ফিকির শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে দেশের বাজার দেশীয়, ভারতীয় ও মিয়ানমারের পেঁয়াজে সয়লাব। যেখানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহে ছিল ২২ থেকে ২৪ টাকা, বৃহস্পতিবারের বাজারে তা ২৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রসুনে স্বস্তি থাকলেও প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা।

প্রতি বছর ছোলার চাহিদা রমজানে বেশি থাকলেও এবার অনেকাংশে কম। ভালো মানের ছোলা প্রতি কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ছোলার বাজারে কিছুটা স্বস্তি থাকলে রোজা শুরুর পরপরই খুচরা বাজারে ছোলার দাম ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় ঠেকেছে। দেশে রমজানে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টন ছোলা লাগে।

ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার পেছনে এখনো ডলার সংকট, পর্যাপ্ত এলসি না হওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। বরবারের মতো, প্রশাসন প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে; কিন্তু দাম কমছে না।

এদিকে লাগামহীনভাবে দাম বাড়ার কারণে মাঠে নেমেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। পবিত্র রমজান মাসে পণ্যদ্রব্য ক্রয়ে সংযমের পরিচয় দেওয়ার জন্য মাসের বাজার একসঙ্গে না করে সপ্তাহের বাজার করা, দরিদ্রদের মাঝে নিত্যপণ্যের বাজার জোগান ও সরবরাহ ঠিক রাখতে ইফতারসামগ্রী বিতরণের পরিবর্তে নগদ অর্থ বিতরণ করা হলে পণ্যের সরবরাহ ও জোগানে ঘাটতি হবে না বলে জানায় ক্যাব। বাজারের দোকানগুলোতে মূল্যতালিকা না থাকলে, কেউ অতিমুনাফা করলে বা হয়রানি করলে, অবৈধভাবে মজুদ করলে ভোক্তা অধিদপ্তরের হটলাইন নাম্বার ১৬১২১, জেলা প্রশাসন ও ক্যাবের নাম্বারে জানানোর আহ্বান জানানো হয়।

ক্যাবের প্রচার অভিযান শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। ক্যাবের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নাজের হোসেন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলার ও এলসির সংকটসহ নানা অজুহাত দেখালেও সবগুলোর সঙ্গে সত্যতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সব ধরনের ব্যবসায়ী তাদের পণ্যের অধিক মুনাফা আদায়ে মরিয়া। এ কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। সে কারণে অতিমুনাফার এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা একবার সয়াবিন, একবার পেঁয়াজ, একবার ডাল, আটা-ময়দা এভাবে প্রতিটি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর এ ধরনের কারসাজি ও অতিমুনাফার কার্যক্রম এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কালক্ষেপণে সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close