গাজী শাহনেওয়াজ

  ২১ মার্চ, ২০২৩

সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না

দেশের সড়ক-মহাসড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন করছেন অনেকেই। বলা যায়, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল যেন কিছুতেই থামছে না। এটা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া যান চলাচলও বন্ধ হয়নি।

সড়ক ও পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা জানান, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ যথাযথ না হওয়ায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। রবিবার (১৯ মার্চ) সকালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাস ছিটকে পড়ে ২০ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৯ জন। এ ঘটনায় বাস মালিক ও সুপার ভাইজারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জানুয়ারিতে তারাগঞ্জ উপজেলার চিকলি দোয়ালীপাড়া মোড়ে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও অন্তত ১৫ জন আহত হন। ২২ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর কুড়িলে ভিক্টর পরিবহনের বাসের ধাক্কায় নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নিহত হন। এর আগে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় সড়ক দুর্ঘটনাসহ মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। এদিকে, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯ হাজার ৯৫১ জন। সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এ সংখ্যা গেল ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল ২০১৫ সালে। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর ৬৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনা ও মানুষের মৃত্যুর এ সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও প্রাণহানি ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর চলতি বছরে বেশ কয়েকটি বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অর্ধশত এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যাধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করে না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যাধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি ও আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, ‘চালকরা কিভাবে গাড়ি চালান সেটি আমি দেখি না। তবে রোডে শৃঙ্খলা ফেরাতে যত ধরনের পদক্ষেপ আছে, তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। যা-হোক আমি একটি মিটিংয়েং আছি, পরে কথা বলি।’

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে সমাবেশ ও র‌্যালি করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. শাহিন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, এখন সড়ক যেন, ‘মৃত্যু ফাঁদ’। আতঙ্ক নিয়ে সড়কে নামতে হয়, পরিবার কিংবা আপনজনদের কাছে ফিরে যেতে পারবো কি-না শঙ্কা জাগে? এমন দুঃস্বপ্ন বহুদিন বহুকাল ধরে তাড়া করছে। তিনি জানান, প্রতিবছরই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিরাপদ সড়ক দিবস উদযাপন করা হয়, অথচ সড়কে প্রতিদিন শতশত লোকের প্রাণহানি ঘটছে। বিভিন্ন যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পঙ্গুত্ববরণ করে পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন অসহায় লাখো মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১০ সালে দেশি নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ লাখ এবং এরপর ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ মোটরসাইকেল যুক্ত হয়। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন উচ্চ হারে বাড়তে থাকে এবং গত ৫ বছরে ১ লাখের বেশি করে নতুন মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখ এবং এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেলের সংখ্যাই ৪০ লাখের বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন; যা ২০২২ এসে ২ হাজার ৫৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ মোটরসাইকেল মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব বলেন, লক্কর-ঝক্কর ফিটনেস ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক ও মহাসড়কে সর্বত্র। সারা দেশে কেবল মাত্র একটি ভিহিক্যাল ইনসপেকশন সেন্টার সচল’; বাকি সবকটি অচল। এখানেও রয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের বড় রকমের উদাসিনতা। শুধু একটি ভিহিক্যাল ইনসপেকশন সেন্টার দেখিয়ে সারা দেশের গাড়ির ফিটনেস দেওয়া হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close