শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি

  ২১ মার্চ, ২০২৩

বাসচালকের ক্লান্তি ও ঘুমের কারণেই শিবচরে দুর্ঘটনা

তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন

শিবচরের কুতুবপুরে বাস খাদে পড়ে ১৯ যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় চালকের ক্লান্তি ও ঘুমই দায়ী বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশ। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩৩ ঘণ্টারও বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন গাড়িচালক জাহিদ হাসান (৪৫)।

শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জেনেছি, ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক কোনো রকম বিশ্রাম না নিয়েই বাসটি চালাচ্ছিলেন। দীর্ঘ ৩৩ ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালানোর কারণে তিনি ক্লান্ত ছিলেন। সকালে ঘুম ঘুম চোখে বাস চালানোয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বাদী হয়ে ইমাদ পরিবহন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। চালক বেঁচে থাকলে চালক ও কোম্পানি উভয়ের বিরুদ্ধেই মামলা হতো।’ ফরিদপুর জোনের হাইওয়ে পুলিশ সুপার মাহাবুবুল হাসান জানান, ‘বাসটির ফিটনেসে ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত শেষেই বাসটির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা গেছে, রবিবার (১৯ মার্চ) সকাল ৮টার দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি শিবচরের পাঁচ্চর পার হয়ে কুতুবপুর সংলগ্ন এক্সপ্রেসওয়েতে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের আন্ডারপাসের পাশে সংযোগ সড়কে আছড়ে পড়ে। এ সময় বাসটির একটি অংশ আন্ডারপাসের ওপর এবং অন্য অংশ এক্সপ্রেসওয়ের ঢালুতে ঝুলে ছিল। ঘটনাস্থলেই গাড়ির মধ্য থেকে ১৪ জনের মরদেহ বের করা হয়। শিবচর হাসপাতালে মারা যায় ৩ জন এবং ঢাকাতে আরো ২ জন।

রবিবার বিকেলে চালক জাহিদের লাশ শনাক্ত করার জন্য শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন তার ছেলে রাতুল হাসান। এ সময় তিনি বলেন, ‘মাসে দুই দিন বাড়ি আসতে পারেন বাবা। গাড়ি চালিয়ে তিনি সব সময় ক্লান্ত থাকেন। গত পরশু ঢাকা, পিরোজপুর, খুলনা রুটে পাঁচটি ট্রিপে গাড়ি চালিয়েছেন। বাবা শনিবার রাতে ফোনে জানান, তিনি অনেক ক্লান্ত ছিলেন। রবিবার ঢাকার থেকে এসে বাসায় এক দিন বিশ্রাম নেবেন এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাবা আমাদের চিরতরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন।’

নিহতদের মধ্যে সাতজনই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার। এছাড়া নিহতদের মধ্যে খুলনার চারজন, ফরিদপুর, খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পাবনার একজন করে রয়েছে।

নিহতরা হলেন গোপালগঞ্জের গোপিনাথপুর এলাকার তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া, বনগ্রাম এলাকার শামসুল শেখের ছেলে মোশতাক আহম্মেদ, সদর উপজেলার নশর আলী শেখের ছেলে সজীব শেখ, পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ হোসেনের মেয়ে সুইটি আক্তার, টুঙ্গিপাড়ার কাঞ্চন শেখের ছেলে করিম শেখ, সদর উপজেলার আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি, মুকসেদপুর এলাকার আমজেদ আলীর ছেলে মাসুদ আলী, খুলনার সোনাডাঙা এলাকার শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন, খুলনা সাউথ সেন্ট্রাল রোড এলাকার চিত্তরঞ্জন ঘোষের ছেলে চিন্ময় প্রসূন ঘোষ, ডুমুরিয়া এলাকার পরিমল সাদুর ছেলে মহাদেব কুমার সাধু, আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লা ছেলে আশফাকুর জাহান লিংকন, বাগেরহাটের শান্তি রঞ্জন মজুমদারের ছেলে অনাদি মজুমদার, ফরিদপুরের হিদাডাঙ্গা এলাকার সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল, নড়াইলের লোহাগড়া এলাকার বকু শিকদারের ছেলে ফরহাদ শিকদার, বাসের চালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আকবরের ছেলে জাহিদ হাসান ও বাস সুপারভাইজার মো. মিরাজ এবং বাসের হেলপার পাবনার সুজানগর এলাকার গহর আলীর ছেলে ইউসুফ আলী।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম জানান, ‘শিবচরে ১৭ জনের মরদেহ ছিল। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শনাক্তকৃতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

শিবচরের পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়য়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে ১৯ জন নিহতের ঘটনায় ইমাদ পরিবহনের কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে মামলা করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

রবিবার (১৯ মার্চ) রাতে শিবচর থানায় মামলাটি করেন শিবচর হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট জয়ন্ত সরকার।

শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, ‘বাসটির যান্ত্রিক ত্রুটি আর বেপরোয়া গতির কারণেই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়েছে উল্লেখ করে থানায় ইমাদ পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করে হাইওয়ে পুলিশ।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বাদী হয়ে ইমাদ পরিবহন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। চালক বেঁচে থাকলে চালক ও কোম্পানি উভয়ের বিরুদ্ধেই মামলা হতো।’

এদিকে, মাদারীপুর জেলার শিবচরের এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। সোমবার (২০ মার্চ) সকালে শিবচরের এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনাস্থলে আসেন তদন্ত কমিটি।

মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরার নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্য মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ফকির (পিপিএম), বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি, মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন। এছাড়াও বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দল কার্যক্রম শুরু করেছে।

তদন্ত কমিটি প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদারসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া দুর্ঘটনাকবলিত বাস, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের কথা রয়েছে তদন্ত কমিটির। ২ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক।

তদন্ত কমিটির প্রধান পল্লব হাজরা বলেন, ‘তদন্ত কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের প্রতিবেদন জমা দেব।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close