গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩

সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় পরিবর্তন নয়

* নতুন উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়নের নাম সংযোজন হবে * পূর্ণাঙ্গ জনশুমারির প্রতিবেদন পাচ্ছে না কমিশন

বড় পরিবর্তন আসছে না ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে। ছোটখাটো সংশোধনী এনে সন্তুষ্ট থাকা লাগতে পারে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। কারণ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে সীমানায় বড় পরিসরে পরিবর্তন আনার সুযোগ কম।

ব্যাপকভাবে সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনতে হলে দেশের সর্বশেষ জনশুমারির চূড়ান্ত পরিসংখ্যান প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে (বিবিএস) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির আগে পূর্ণাঙ্গ জনশুমারির প্রতিবেদন প্রকাশ করবে না সংস্থাটি। ফলে কমিশন বৃহৎ পরিসরে যে সংসদীয় আসনের সীমানায় বিন্যাস আনতে চেয়েছিল আপাতত সেটা হচ্ছে না- এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে ইসি সূত্র।

অন্যদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সম্ভাব্য ভোট ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্য ইসির ঘোষিত পথনকশা (রোডম্যাপ) অনুযায়ী এপ্রিলের মধ্যে সীমানা বিন্যাসের জন্য এপ্রিলে সংক্ষুব্ধরা আবেদন জমা দিতে পারবে। এসব দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তি করে মে’র মধ্যে শুনানি চূড়ান্ত করতে হবে। এরপর কমিশনকে সীমানা বিন্যাসের কাজ শেষ করতে হবে ৩০ জুনের মধ্যে। তাই বড় পরিবর্তনের চিন্তা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে কমিশন। এছাড়া না-ও লাগতে পারে অঞ্চলভিত্তিক গণশুনারির। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সর্বশেষ জনশুমারির রিপোর্ট ইসিকে কবে দিচ্ছেন জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘কমিশন আমাদের কাছে জনশুমারির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চেয়েছিল; আমরা শুমারির তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিলাম তা সরবরাহ করেছি। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আমরা তাদের আপাতত দিতে পারছি না। এরই মধ্যে কমিশনকে সেটা মৌখিকভাবে জানিয়েছি। কারণ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি। তবে কমিশনের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যোগযোগ বন্ধ হয়নি। তারা যখন যে তথ্য আমাদের কাছে চাইছেন সেগুলো দিয়ে আমরা সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’

পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না পেয়ে সীমানা বিন্যাসের কাজ কীভাবে সম্পন্ন করবেন- জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো, আনিছুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সীমানা বিন্যাস সংক্রান্ত আইনে যে বিধান আছে তার আলোকে হবে। কারণ পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট না পেলে সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করে বসে থাকার সুযোগ নেই। কারণ ৩০ জুনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে সীমানার কাজ শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি বিধান অনুসারে পূর্ববর্তী জনশুমারির রিপোর্ট অর্থাৎ বিদ্যমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে এ কাজটি সম্পন্ন করা হবে। কারণ জনশুমারির প্রাথমিক খসড়া দিয়ে সীমানা বিন্যাসের সুযোগ নেই। ফলে সীমানায় বড় পরিবর্তন আসল কি না, তার প্রতিফলন ঘটানো ইসির কাজ নয়। বিদ্যমান বিধান অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে।’

বিবিএসের তথ্যমতে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে প্রথম জনশুমারি হয় ১৭৭৪ সালে, পরবর্তী সময়ে ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ ও সর্বশেষ ২০২২-এ। প্রতিবারই গণনাকৃত জনসংখ্যায় কম-বেশি হয়েছে। প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত ছয়বার জনশুমারি হয়েছে। ১৭৭৪ সালে প্রাথমিক গণনায় জনসংখ্যা ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন; চূড়ান্ত ফলে বেড়ে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৯৮ জন দাঁড়ায়। একইভাবে ১৯৮১ সালে ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জন থেকে বেড়ে ৮ কোটি ৯৯ লাখ ১২ হাজার হয়। ২০১১ সালে গণনায় ১৪ কোটি ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ থেকে বেড়ে ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ জন হয়। সর্বশেষ প্রাথমিক গণনায় জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। বিবিএস প্রাথমিক গণনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যার তথ্য কমিশনকে সরবরাহ করেছে। কিন্তু সীমানা বিন্যাসের জন্য কমিশনের দরকার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়ে আসন বিন্যাস করা হলে সংসদীয় আসনের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হবে না।

কারণ স্বাধীনতা সংসদীয় আসনের সীমানা যতবার পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে ২০০৬ সালে গঠিত ড. শামসুল হুদার কমিশন জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। এর ফলে ঢাকায় আটটি আসন বাড়ে, বরিশাল ও খুলনাসহ বিভাগীয় শহরে আসন কমে। সর্বোচ্চ ১৪৩টি আসনে আমুল পরিবর্তন আসে। এর আগে ১৮৮৪ ও ১৯৯১ সালেও বড় পরিবর্তন এনেছিল তৎকালীন কমিশন।

এরপর কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ৫০টি সংসদীয় আসনে এবং সর্বশেষ কে এম শামসুল হুদা কমিশন ২৫টি আসনে সীমিত পরিসরে পরিবর্তন আনে। এবার জনশুমারির গণনা হওয়ায় বর্তমান কমিশন কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল। কিন্তু জনশুমারির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বিবিএস থেকে প্রকাশ না পাওয়ায় বড় পরিবর্তন ছাড়াই শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি ইসি।

ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সীমানা বিন্যাস কাজ খুব সীমিত পরিসরে করতে হবে। কারণ বিবিএস থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়া যাবে এখনই- এমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় আসন থেকে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে আসনে পরিবর্তন ও বহাল রাখার অনুরোধ জানিয়ে আবেদন এসেছে। এগুলো অভিযোগ আকারে নথিভুক্ত করা হয়নি। কারণ এপ্রিলে আবেদন আহ্বান করা হবে; ওই সময়ে সেগুলো আমলে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে, এবার আঞ্চলিক শুনানির প্রয়োজন পড়বে না। কারণ সীমানা বিন্যাস করা হবে শুধুমাত্র নতুন গঠিত উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ এগুলোকে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদের এলাকা কক্সবাজারে ঈদগাঁ উপজেলা, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর পৌরসভা।

সূত্র মতে, কিছু সংসদীয় আসনের উপজেলা অখণ্ড আছে। আবার এক উপজেলা দুটি সংসদীয় আসনেও পড়েছে। এ রকম ৪৫টি উপজেলা বিভক্ত হয়েছে আসন বিন্যাসের কারণে। আসনগুলো হলো- ঠাকুরগাঁও-২, ঠাকুরগাঁও-৩, সিরাজগঞ্জ-১, সিরাজগঞ্জ-২, পাবনা-১, পাবনা-২, চুয়াডাঙ্গা-১, চুয়াডাঙ্গা-২, ঝিনাইদহ-২, ঝিনাইদহ-৪, যশোর-৩, যশোর-৪, মাগুরা-১, মাগুরা-২, নড়াইল-১, নড়াইল-২, খুলনা-৩, খুলনা-৪, সাতক্ষীরা-৩, সাতক্ষীরা-৪, মানিকগঞ্জ-২, মানিকগঞ্জ-৩, ঢাকা-২, ঢাকা-৩, ঢাকা-১৯, গাজীপুর-৩, গাজীপুর-৫, নরসিংদী-১, নরসিংদী-২, নারায়ণগঞ্জ-৪, নারায়ণগঞ্জ-৫, ফরিদপুর-২, ফরিদপুর-৪, গোপালগঞ্জ-১, গোপালগঞ্জ-২, মাদারীপুর-২, মাদারীপুর-৩, নোয়াখালী-১, নোয়াখালী-২, লক্ষ্মীপুর-২, লক্ষ্মীপুর-৩, চট্টগ্রাম-৭, চট্টগ্রাম-৮, চট্টগ্রাম-১৪ ও চট্টগ্রাম-১৫। এগুলোর পরিবর্তন আনতে হলে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অভিযোগ জমা হবে। কারণ বিন্যাস হওয়া এসব আসনে এরই মধ্যে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। নতুন করে বিন্যাস করতে গেলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কমিশন। এ ছাড়া উপজেলা খণ্ড থাকলেও ভোটগ্রহণ বা প্রশাসনিক কাজে কোনো জটিলতা তৈরি করছে না। নদী কিংবা দুর্গম এলাকা হলেও দুর্ভোগ ছাড়াই তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন। এসব অমীমাংসিত আসনে হাত দিলে বড় ধরনেন ঝুঁকিতে পড়া লাগতে পারে ইসিকে। তাই নতুন চ্যালেঞ্জ না নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জনশুমারির রিপোর্ট না পাওয়া অজুহাতে মোটাদাগে পরিবর্তন না এনেই সীমানার কাজ শেষ করতে পারে কমিশন।

জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা আইন-২০২১-এ বলা আছে, সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সংখ্যক সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পুরো দেশকে উক্ত সংখ্যক একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং আদমশুমারির ভিত্তিতে যতদূর সম্ভব বাস্তবভিত্তিক বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। আইনের ৮ নম্বর ধারায় একটি উপধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে বলা আছে, দৈব-দুর্বিপাকে বা অন্য কোনো কারণে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করা না গেলে বিদ্যমান সীমানার আলোকে নির্বাচন হবে। আইন অনুযায়ী কোনো কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা না গেলে বিদ্যমান আসনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close