এইচ আর তুহিন, যশোর

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

ক্ষয়ে যাচ্ছে মধুকবির দত্তবাড়ির নিদর্শন

সংস্কার ও নান্দনিক করতে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে * পর্যটকদের কাছে হবে আকর্ষণীয়

বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি সাগরদাঁড়িতে একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে কয়েক বছর ধরে। সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শান্তি নিকেতনের আদলে মধুসূদনের জন্মভূমি গড়ে ওঠেনি যুগোপযোগী পদক্ষেপের অভাবে। বরং ক্ষয়ে যাচ্ছে দত্তবাড়ির প্রাচীন নিদর্শনগুলো।

মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি ঘিরে ভক্তদের নানা স্বপ্ন থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি দীর্ঘদিনেও। তার জীবন ও দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নানামুখী পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, দত্তবাড়ি সংস্কার ও নান্দনিক করতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক।

যশোরের কেশবপুর উপজেলায় কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়ির দত্তবাড়ি। এটি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি যশোরের কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যের মহাকবি জন্মভিটাকে ঘিরে রয়েছে নানা স্মৃতি। তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করেছে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রাচীন স্থাপত্য ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ক্ষয়ে যাচ্ছে ইতিহাসও। মধুসূদনের স্মৃতিবিজড়িত দত্তবাড়িতে কাছারী ভবন, পারিবারিক বাসভবন, দুর্গামন্দির, পুকুরঘাট, ব্যবহার্য জিনিসপত্র রয়েছে।

প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কার করা দুইতলা বাড়িটির মোট ছয়টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ওপরে তিনটি ও নিচে তিনটি। নিচতলায় রয়েছে কবি পরিবারের একটি মন্দির ও মধুসূদন জাদুঘর। মধুসূদন জাদুঘরে কবির ব্যবহার করা খাট, চেয়ার, কাঠের সিন্দুক, পাথরের গামলা, কোরিয়া গ্রামোফোন, দেশজ ঐতিহ্যবাহী দা, টিফিন কেরিয়ার ও আলমারি সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এছাড়া রয়েছে একটি ছোট পাঠাগার। ভবনের একদম উত্তর দিকে ছাদহীন দেয়াল ঘেরা একটি অসাধারণ নির্মাণশৈলীর একটি কক্ষ। এই কক্ষের কোনার দিকে একটি তুলসী গাছ রয়েছে। কপোতাক্ষ পাড় থেকে বাড়ির প্রবেশপথে রয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি ভাস্কর্য। প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনের সঙ্গে মিশে রয়েছে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নানা স্মৃতি। তবে মহাকবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে কেশবপুরের প্রবীণ নাগরিক সাংবাদিক আজিজুর রহমান বলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি ও তার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর বিক্ষিপ্তভাবে দত্তবাড়ি সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে মানুষের কাছে নান্দনিকভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়নি। এজন্য তার বসতবাড়ির প্রাচীন নিদর্শন ও স্থাপনা যেমন ক্ষয়ে যাচ্ছে, তেমনি কর্মময় জীবন ও তার সাহিত্যকর্মের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যাচ্ছে না।

সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় চাই- আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, মাইকেল মধুসূদনের জন্ম সাগরদাঁড়িতে। কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময়ে কেটেছে ভারত ও ফ্রান্সে। তাই মধুসূদন শুধু বাংলাদেশের নয়। শান্তি নিকেতনের আদলে সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাকে তুলে ধরা সম্ভব। এতে দেশ বিদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের মিলনমেলায় পরিণত হবে সাগরদাঁড়ি।

প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্ববধানে পরিচালিত মাইকেল মধুসূদন (এমএম) দত্তবাড়ির দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ান আইরিন পারভীন বলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িতে প্রতি বছর ৮০-৯০ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। এতে বছরে ১৩-১৪ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হয়। তবে এটি আশানুরূপ নয়। নানা সমস্যার কারণে পর্যটকরা এখানে আসতে আগ্রহী হয় না। সুযোগ-সুবিধার অভাব ছাড়াও জনবল সংকট রয়েছে।

প্রহরীর দায়িত্বে থাকা হারুন অর রশিদ বলেন, শীতের সময় লোকজন বেশি আসে। অন্য সময় লোক খুব কম আসে। লোকজন এসে হতাশা প্রকাশ করে। স্থাপনাগুলো সংস্কার করলে আরো ভালো হতো।

মিউজিয়াম অ্যাটেন্ডেন্ট নাজমা আক্তার বলেন, মিউজিয়ামের জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটা আরো আধুনিক উপায়ে সংরক্ষণ করলে ভালো হয়। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রাচীন ভবনগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন। যোগাযোগব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে।

প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, দীর্ঘদিনেও আমরা মাইকেল মধুসূদনকে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারিনি, এটা সত্য। তবে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদনকে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। সংস্কৃতি চর্চার অংশ হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের যাত্রাপালা এখনো শীর্ষে রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করছে। প্রাচীন স্থাপত্য ও নিদর্শনগুলো ক্রমে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এটি সংস্কার ও নান্দনিক করে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এম এম দত্তবাড়ির প্রাচীন ভবন, কাচারী বাড়ি, বসতবাড়ি সংস্কার ও সংরক্ষণ এবং প্রাচীর নির্মাণের জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্প পাশ হলে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হবে দত্তবাড়ি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close