কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

ছোট হয়ে আসছে কর্ণফুলী

ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে কর্ণফুলী। ২০০০ সালের মাপে যে নদীটি আড়াআড়ি প্রশস্ত ছিল ৯৩০ মিটার, বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটারে। প্রতিদিন একটু একটু করে দখল হচ্ছে কর্ণফুলী। দখল উচ্ছেদে মাঝে মাঝে তৎপরতা দেখা গেলেও এটি ‘স্রেফ আইওয়াশ’ হিসেবে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বেশ কয়েকবার মহাসমারোহে উচ্ছেদ শুরু হলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা থেমে যায়। উচ্ছেদের আগে বেশ হাঁকডাক চলে। কিন্তু প্রতিবারই থমকে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম।

অভিযোগ রয়েছে, নদী দখলের পেছনে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অনেক সরকারি কর্মকর্তাও জড়িত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অচিরেই কর্ণফুলী নদীটি সরু খালে পরিণত হবে।

২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর ‘গুগল টাইমলেপস্ ম্যাপসে’র ধারণ করা চিত্র অনুসারে চাক্তাই খালের মোহনায় কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা ম্যাপ লেনথ্ ৯৩০ দশমিক ৩১ মিটার, গ্রাউন্ড লেনথ্ ৯৩০ দশমিক ৩২ মিটার। ১৯৮৫ সালের ধারণকৃত চিত্রে দেখা যায় চাক্তাই খালের মোহনায় ম্যাপ লেনথ্ ৯৫২ দশমিক ২৮ মিটার, গ্রাউন্ড লেনথ্ ৯৫২ দশমিক ২৯ মিটার। ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখের ম্যাপে ধারণ করা চিত্রে দেখা যায় চাক্তাই খাল ও রাজাখালী খালের মুখে চর জেগে ওঠার কারণে ম্যাপ লেনথ্ ৬৬৬ দশমিক ৫৬ মিটার, গ্রাউন্ড লেনথ্ ৬৬৬ দশমিক ৫৬ মিটার। কিন্তু এই এলাকায় জেগে ওঠা চরে কোনো ধরনের স্থাপনার অস্তিত্ব ছিল না। ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির ধারণ করা চিত্রে দেখা যায় চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে কর্ণফুলীর জেগে ওঠা চর দখলে চলে গেছে। এ সময়কার চিত্রে নদীর প্রশস্ততা এসে দাঁড়িয়েছে ম্যাপ লেনথ্ ে৪৫১ দশমিক ১৭ মিটার, গ্রাউন্ড লেনথ্ ে৪৫১ দশমিক ১৭ মিটারে। ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর ধারণ করা ভয়াবহ চিত্র নজরে পড়ে। চিত্রে দেখা যায়, কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচে রাজাখালী খালের মোহনায় কর্ণফুলীর প্রস্থ মাত্র ম্যাপ লেনথ্ মাত্র ৪৪৭.৩৭ মিটার, গ্রাউন্ড লেনথ্ ৪৪৬.৩৭ মিটার।

বলা হচ্ছে, নদীর পলিমাটি খনন না করার কারণে এখানে নদীর অংশ প্রায় ৯৩১ মিটার থেকে ছোট হয়ে ৫৮৬.৮৯ মিটার হয়ে গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ৮৬৫১ দাগে কর্ণফুলী নদীর চরে সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য সমবায় সমিতিকে লিজ দিয়ে জেগে ওঠা চরের পাশে আরো নদী ভরাট করে মাছ বাজার ও বরফ কল গড়ে তুলেছে, যা প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০/এসএটিএ১৯৫০, পানি আইন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও থেমে নেই এসব দখল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খনন ও শাসন না করায় শাহ আমানত ব্রিজের নিচ থেকে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় তিন কিলোমিটার চর জেগে সংকীর্ণ হয়ে গেছে কর্ণফুলীর গতিধারা। সংকীর্ণ গতিধারায় পানির স্রোতের কারণে শাহ আমানত সেতুর চার ও পাঁচ নম্বর পিলারের নিচে ৭৮.৬ ফুট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, যা শিকলবাহা খালের মোহনা থেকে ফিরিঙ্গি বাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার নদীর তলদেশের সর্বোচ্চ গভীরতা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে বড় জলোচ্ছ্বাস বা অতি বর্ষণে পানির স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শাহ আমানত সেতু। ধসে যেতে পারে সেতুর দক্ষিণ পাশের গাইড ওয়াল।

নদী ও খাল রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘কর্ণফুলী দখল উচ্ছেদের জন্য আমরা লড়ে যাচ্ছি। উচ্চ আদালতের রায়ও মানছে না প্রভাবশালীরা। নানাভাবে দখল হচ্ছে নদীটি। প্রতিদিন কমছে নদীর প্রশস্ততা।’ তিনি বলেন, ‘এর প্রভাব পড়ছে শাহ আমানত সেতুতে। সেতুর উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মাঝখানে গভীরতা ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী থাকার কথা ২৫ ফুট। সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে মাত্র ৭.৭ ফুট, ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। বাস্তবে ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে চর জেগে উঠেছে। সেখানকার চরে জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যাচ্ছে। সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলার এলাকায় স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। সেখানে বর্তমান গভীরতা ৬৪ দশমিক ৭ ফুট। ৪ ও ৫ নম্বর পিলার এলাকায় (দক্ষিণ তীরের পাশে) নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট (চর পাথরঘাটা এলাকার মাপ অনুযায়ী) কিন্তু ৪ পিলারের পাশে গভীরতা ৭৮.৬ ফুট, যা কর্ণফুলী নদীর ফিরিঙ্গি বাজার থেকে শিকলবাহা খালের মুখ প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় সবচেয়ে গভীরতম স্থান। প্যাডোমিটার দিয়ে পরিচালিত সার্ভেতে এই স্থানে পিলারের পাশে নদীর তলদেশের মাটিতে ছোট-বড় অনেক ফাটল দেখা গেছে, যা শাহ আমানত সেতুর জন্য উদ্বেগজনক। ব্রিজের দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি নদীর তলদেশে গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় তীরের মাটি ধসে ব্রিজ ধসে যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।’

সূত্রমতে, বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩২১ কোটি টাকার ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এই এলাকায় তিন বর্গকিলোমিটার চর জেগে উঠেছে। বর্তমানে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখ দখল করে ভেড়া ও মাছ বাজার গড়ে ওঠায় ভয়াবহ ধ্বংসের কবলে পড়েছে কর্ণফুলী। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নদী লিজ দিয়ে মাছ মাজার গড়ে তোলায় অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদে বিলম্ব হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হলে গত ২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হুসেন প্রদত্ত উচ্ছেদ নোটিশ (৪৭/২০১৯) অনুযায়ী হাইকোর্টের নির্দেশমতো চাক্তাই খালের মোহনায় গড়ে ওঠা মাছ বাজারসহ ৪৭ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা আঠারো শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। একই সাথে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচ থেকে চাক্তাই খালের মোহনা পর্যন্ত তিন কিলোমিটারব্যাপী জেগে ওঠা চর খনন করে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। শাহ আমানত সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলারের নিচে সৃষ্ট গর্তে বোল্ডার ঢেলে মাটি ক্ষয়রোধ করাসহ সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রণীত স্ট্র্যাটেজিক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে মেরিনার্স পার্ক, মাছ, বাজার ও ভেড়া মার্কেট এলাকার সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খনন করতে হবে। অন্যথায় কর্ণফুলীর মরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close