আবদুল্লাহ হেল বাকী, ধামইরহাট (নওগাঁ)

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০২২

যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন

নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলার অবস্থান। ওই উপজেলার উমার ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষকের সন্তান আফজাল হোসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখতে গিয়ে তার পায়ে গুলি লাগে। যুদ্ধচিহ্ন নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। তিনি এখন ধামইরহাট উপজেলা পৌর শহরের দক্ষিণ চকযদু টিঅ্যান্ডটি মহল্লার বাসিন্দা।

৭১-এর উত্তাল মার্চের পর থেকেই সারা দেশের মতো ধামইরহাটেও পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব শুরু হয়। কেউ প্রাণ বাঁচাতে, কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত পেরিয়ে ওপর চলে যেতে থাকেন। এরই মধ্যে তাদের বাজারে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর আফজাল হোসেন ধামইরহাট উপজেলার শেষ সীমানা আলতাদিঘীর পূর্ব পাড়ে পালিয়ে যান। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পিতা-মাতাকে না বলে ভারতে চলে যান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির বাঙ্গালিপুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। এরপর সেখানে ভর্তি হন আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন আবদুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আবদুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অনেকেই। সেখানে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবুল আজাদ। সেখানে এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার পর ১০০ জনের একটি টিমকে আর্মি ভ্যানে জলপাইগুড়ি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে মেজর রেড্ডীর অধীনে ট্রেনিং করেন। জলপাইগুড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে ১৫ দিন পর সবাইকে বিমানে করে দর্জিলিং বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া দেরাদুনে এক মাস ট্রেনিং হয় মেজর মালহুতরা ও মেজর চোয়ানের অধীনে।

যুদ্ধের দুঃসাহসী অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠেন আফজাল। ফিরে যান সেই অগ্নিঝরা দিনে। একের পর এক বলে যান অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতির গৌরবময় অধ্যায়। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একাত্তরের রণাঙ্গন। ট্রেনিং শেষে আফজাল হোসেন, আবদুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আবদুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অন্তত ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ধামইরহাট এলাকার কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

১০ ডিসেম্বর চৌঘাট ডাঙ্গী নামক স্থানে যুদ্ধের অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আত্রাই নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে শত্রুর অবস্থানের দিকে এগোতে থাকেন। হানাদারদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই শুরু হয়। ওই সময় তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলছিল। তখন তিনি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় বাম হাতটি ভেঙে যায়। বাম পায়ের হাঁটুর নিচে গুলিবিদ্ধ হন, তবে সেটি মারাত্মক ছিল না। এখন সেই হাতটি ভালো হলেও আজও বাঁকাই আছে। পায়ে এখনো বহন করছেন যুদ্ধচিহ্ন। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত ওই সময় সামনা সামনি যুদ্ধে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার সহযোদ্ধা লোকমানের দেহে। একই সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিকও নিহত হয়। ওই লড়াইয়ের দুদিন পর বীর বেশে বিজয় নিয়ে ঘরে ফেরেন বীর মুক্তিযোদ্ধ আফজাল হোসেন। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য পাননি কোনো খেতাব বা পদবি।

আফজাল হোসেন বর্তমানে নিজ বাড়িতে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন। যখনই যাকে কাছে পান তখনই বলতে থাকেন ৭১-এ ফেলে আসা সেই অগ্নিঝরা দিনের কথা। আফজাল হোসেন এখনো বেঁচে আছেন শরীরে যুদ্ধদিনের সেই ক্ষত নিয়ে। বেঁচে আছেন শহীদ লড়াকু সহযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close