নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২২

নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, নিহত ১

রিজভী, আমান, সালাম, খোকন, শিমুল, এ্যানি ও জুয়েল আটক * দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান * মির্জা ফখরুলকে কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা * সরকার সমর্থকদের দখলে নয়াপল্টন

রাজধানীর পল্টনে পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় নয়াপল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে বুধবার (৭ ডিসেম্বর) বিকালে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকে বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলটির সমাবেশস্থল হিসেবে নয়াপল্টন দাবি থাকলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো অনুমতি মিলেনি। এ অবস্থায় পল্টনের জমায়েত প্রতিরোধ করতে মাঠে নামে পুলিশ। এ সময় পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের সরাতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। এতে পুলিশের গুলিতে মকবুল হোসেন (৪০) নামে বিএনপির এক কর্মী মারা যাওয়ার দাবি করেছে বিএনপি। এছাড়া ১৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

এদিকে সংঘর্ষের আগে-পরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন এ্যানি, সেচ্চাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েলসহ প্রায় ৫০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয়ে এলে প্রথমে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তিনি কার্যালয়ের সামনে বসে পড়েন। সন্ধ্যার পর থেকে বিএনপির কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর নয়াপল্টন রোডটির দখল নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সড়কটি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দখলে রয়েছে।

জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে ঘিরে দুদিন ধরে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছিল কয়েক শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী। গতকাল সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে নানা স্লোগান দিতে থাকে। বিকাল ৩টার দিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। বিএনপি নেতাকর্মীরাও পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে জবাব দেয়। শুরু হয় দুপক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় স্পেশাল বাহিনী সোয়াতও।

প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ঘটনার সময় পুরো নয়াপল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের লাগাতার টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপে টিকতে না পেরে পিছু হটে বিএনপি নেতাকর্মীরা। আশপাশের গলিতে অবস্থান নেয় তারা।

এদিকে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে বেশ কয়েকজন ছাত্রদল নেতা গুলিবিদ্ধ হন। তারা হলেন তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদল নেতা আলদীন, জুয়েল, আরিফ, নিয়াজ মোরশেদ। তাদের রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) বাচ্চু মিয়া বিএনপির মুকুল নামের একজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘নিহতের শরীরে শটগানের গুলির আঘাত রয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নয়াপল্টন থেকে বুধবার পৌনে ৪টায় মকবুল হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান গণমাধ্যমকে বলেন, সমাবেশের স্থান নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন এই সংঘর্ষ শুরু হলো। সকাল থেকেই পল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেননি। একপর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছে। এ সময় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান : রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে পুলিশ। এসময় বিএনপি কার্যালয়ের ভেতর প্রতিটি রুমে তল্লাশি চালায় পুলিশের একটি দল। বুধবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে পুলিশের একটি দল বিএনপির কার্যালয়ে প্রবেশ করে। কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের পর প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপির অভিযোগ, কার্যালয়ের ভেতর থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয়ের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাকে ঢুকতে দেয়নি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কার্যালয়ে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুটপাতে বসে পড়েন মির্জা ফখরুল।

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বসে পড়েছেন মির্জা ফখরুল : রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পুলিশ। বুধবার বিকাল সোয়া ৪টার পর পুলিশের একটি দল বিএনপির কার্যালয়ে অভিযান শুরু করে। এরপর সাড়ে ৪টার দিকে সেখানে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এ সময় ভেতরে ঢুকতে গেলেও পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। পরে প্রায় ২০ মিনিট পর তাকে কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতি দেয় পুলিশ। তবে কার্যালয়ে প্রবেশ না করে সামনে বসে পড়েন তিনি।

নয়াপল্টন থেকে রিজভী, এ্যানি ও জুয়েলসহ আটক অনেকে : রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে আটক করেছে পুলিশ। সন্ধ্যার পর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকেও আটক করে পুলিশ।

এর আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের জুয়েলসহ অন্তত ২০-২৫ জনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। বুধবার বিকাল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাকে আটক করে প্রিজনভ্যানে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এর ঘণ্টাখানেক আগে বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভুইয়া জুয়েলকে আটক করে পুলিশ। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে দুজনকে আটক করা হয়। এছাড়া বিএনপি নেতা ও চেয়ারপারসনের সাবেক বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।

আইন অমান্য করে সমাবেশ করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা : ডিএমপি কমিশনার

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, জননিরাপত্তা ও জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে পল্টন পার্টি অফিসের সামনে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দেওয়া যাবে না। আইন অমান্য করলে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বুধবার সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন এ কথা বলেন তিনি।

খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পল্টনের সামনে ১০ লাখ লোকের জায়গা হবে না। সর্বোচ্চ এক লাখ লোক পল্টনে দাঁড়াতে পারবে। বাকি ৯ লাখ লোক ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে। যার উপর বিএনপির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

তিনি বলেন, আমরা গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বিএনপি ঢাকা শহরে ১০ লাখ লোক জমায়েতের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কাজেই পার্টি অফিসের সামনে জনদুর্ভোগ করে এবং ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করে তাদের সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। আপনারা (বিএনপি) যেকোনো খোলা মাঠে যেতে পারেন বা অন্য কোনো প্রস্তাব দিতে পারেন। অন্য প্রস্তাব হিসেবে তাদের বলা হয় ইজতেমা মাঠ আছে, সেখানে আপনারা ১০ লাখ লোক জমায়াত করতে পারবেন। পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার মাঠ আছে, সেখানে যেতে পারেন।

নয়াপল্টন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান : নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর ওই এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

বুধবার বিকালে ফকিরাপুলের দিক থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি মিছিল বের হয়। সন্ধ্যার পর জোনাকী সিনেমা হলের সামনে পল্টন, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানা ছাত্রলীগ অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেয়। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টেও মিছিল, স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকাল থেকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহকারে অবস্থান নেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের একটি দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। মিছিল দেখা গেছে ভূতের গলি, হাতিরপুল ও রাসেল স্কয়ারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close