মনিরুল ইসলাম

  ০৪ ডিসেম্বর, ২০২২

তবু জমে আছে ঘৃণা!

জন্মভূমির ভিটেমাটি ছেড়ে রিক্ত হাতে শরণার্থী হয়ে সুইজারল্যান্ড এসেছিলেন জাদরান শাকিরির পরিবার। তার জন্ম কসোভোতেই। তখনকার স্মৃতি তার এখন কেবল ঝাঁপসা। সে সময়ের অবস্থা বোঝার মতো বয়স হয়নি তার। বাব ছিলেন রেস্টুরেন্টের কর্মচারী আর মা ছিলেন অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। শাকিরি আর দুই ভাইকে নিয়ে খুব কাকভোরে কাজে বেরোতেন তাদের মা। মাঝেসাঝে ছেলেরা জানালার কাচ পরিষ্কার করার কাজে মাকে সাহায্য করতেন। এভাবেই রোজগারি করতেন। দুমুঠো খেয়ে দিন পার করতেন কোনো মতে। কখনো আধপেটে থাকতেন। শুধু খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট ছিল না। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নামলে হাড় কাঁপানো শীতে জবুথবু অবস্থা। গা গরম করার মতো ছিল না জামা-কাপড়। কী নিদারুণ কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন অতিবাহিত করেছিলেন!

বাবা-মায়ের হাত ধরে শাকিরিরা এসেছিলেন সুইজারল্যান্ড ঠিক। কিন্তু কসোভোতে ফেলে এসেছিলেন চাচাদের। যুদ্ধে শুরুতে তাদের ঘরবাড়ি সবকিছু পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। তাই নিঃস্ব চাচাদের জন্য এখান থেকে টাকাণ্ডপয়সা পাঠাতে হতো শাকিরিদের। ছোটবেলা থেকে শাকিরির ফুটবলের সঙ্গে সখ্য ছিল। সুইজারল্যান্ডের স্কুলের বেশিরভাগই শিক্ষার্থীর ফুটবলের প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কেবল শাকিরির তুমুল আগ্রহ ফুটবলের প্রতি। কারণ শাকিরির জন্মভূমির সব ছেলের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ফুটবল। তাই ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো জো নেই। শাকিরি ছিলেন আপাদমস্তক রোনালদোর ভক্ত। তিনি তখন রোনালদোর মতো চুলের ছাঁট দিয়ে স্কুলে যেতেন। লোকে কী বলে তাতে কান দিতেন না। নিজেদের মতো চলতেন। ভীষণ রকম খামখেয়ালি ছিলেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে রোনালদোকে ফাইনাল ম্যাচে মাঠ ছেড়ে উঠতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ছিলেন। একটা সময় তার জন্মভূমি স্লোভাকিয়াতে যুদ্ধে থেমেছে। জীবন যুদ্ধেও জিতেছেন শাকিরি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে সুযোগ পেয়েছেন সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ দলে। তারপর সোনায় সোহাগা জীবন। এখন খেলছেন তৃতীয় বিশ্বকাপ। দলটির আক্রমণভাগের প্রাণভোমরা শাকিরি। দলের প্রয়োজনে যেকোনো সময় তুরুপের তাস রূপে দেখা যায় তাকে। শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) কাতারের ৯৭৪ স্টেড়িয়ামে অর্ধ মিনিটের ভেতর কয়েকবার মুহুর্মুহু আক্রমণ চালায় সুইজারল্যান্ড। কিন্তু গোল করতে ব্যর্থ পুরোপুরি। ২০ মিনিটের মাথায় ঠিকই গোল করতেন সক্ষম হয়ে সুইজারল্যন্ড। বক্সে ডান প্রান্ত থেকে বাম পায়ের শটে গোল দেন জাদরান শাকিরি। এই নিয়ে সবশেষ ৩ বিশ্বকাপে গোল করেন শাকিরি। শেষমেশ অনেক নাটকীয়তার পর কাতার বিশ্বকাপের ‘জি’ গ্রুপ থেকে নকআউটে পর্বে জায়গা করে নিল। ৩-২ গোলে সার্বিয়াকে হারিয়ে সর্বশেষ দল হিসেবে শেষ ষোলোর টিকিট নিশ্চিত করে সুইসরা। ঘটনাচক্রে ২০১৮ সালে এই সার্বিয়ার সঙ্গে জিতে ‘আলবেনিয়ান ঈগল’ উদযাপন করেছিলেন জাকা ও শাকিরি। তখন ফিফা তাদের জরিমানা করেছিল সেই উদযাপনের জন্য। যার পুরো টাকা এক দিনে কসোভোর জনতা ১৪ হাজার ইউরোও তুলেছেন। জনগণও জানে এই উদযাপনের মাঝে মিশে ছিল বঞ্চনা আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কেননা এই সার্বিয়ান আগ্রাসনের জন্যই দেশান্তরী হয়ে সুইজারল্যান্ড পাড়ি জমিয়েছিলেন সাকাণ্ডশাকিরিরা। পরে ভাগ্যক্রমে সুইজারল্যান্ডের তারকা ফুটবলার হয়ে উঠেছেন তারা। এত আকাশচুম্বি সাফল্য আর ঝাঁ চকচকে জীবনের মাঝে হয়তো সার্বিয়ার প্রতি পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কমেনি একটুও।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close