নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২২

মিত্রবাহিনী গঠন বিজয়ের পথে মুক্তি সৈনিকরা

আজ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের অনবরত হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশাহারা হয়ে পড়ে। বিজয়ের পথে আগুয়ান বাংলার মুক্তি সৈনিকরা। এদিনে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হলো মিত্রবাহিনী। ওইদিন গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।

যৌথবাহিনী ঘোষণার পর মুক্তিপাগল বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যৌথভাবে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এত দিন সীমান্তে প্রকাশ্যে ঘোষণা ছাড়া অন্তরালে মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল- আর আজ থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে- মিত্র-মুক্তিবাহিনীর রক্তে সিক্ত হয়ে যায় বাংলার পবিত্র মাটি, বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা খুবই বিরল- এ যেন ‘স্থাপনা করে রক্তে লিখিলে/শেখ মুজিবরের বাণী।’

এদিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর কুমিল্লায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে মিয়াবাজার দখল করে নেন। এই ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন আমাদের বাঞ্ছারামপুরের ৫০ জনের একটি গেরিলা গ্রুপকে আগরতলার মনতলা ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন এবং এই গ্রুপের ৫ জন শহীদ হয়েছিলেন এবং প্রায় সবাই কমবেশি আহত হয়েছিলেন।

একাত্তরের এই দিনে মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর মাইজদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মুক্ত করে সোনাইমুড়ী- এরপর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর দুর্বার আক্রমণ শুরু করে। এদিকে আখাউড়া সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চলছে বিরতিহীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সাতক্ষীরা সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। রংপুরের পলাশবাড়ীতে পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনারা এবং সেখানে কিছু সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী যে অত্যাচার করেছে, শরণার্থীরা কেন ভারতে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান কেউ করেনি, করতে চায়নি, বিদেশের কাছে বারবার সব বলা হয়েছে কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে মরতে দিতে পারি না, আমরা মরতে দেব না, ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের পূর্ণ সাহায্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে থাকবে।’

জাতির উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আরো বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’ এ ঘোষণার পরপরই ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত যৌথ কমান্ড। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এদিন থেকেই। গভীর রাতে পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী- আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দিল বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা।

তথ্যসূত্র : ফারুক ওয়াহিদ, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, ২ নম্বর সেক্টর বাঞ্ছারামপুর ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (১-১৫ খণ্ড)।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close