মিজান রহমান

  ২৫ নভেম্বর, ২০২২

প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু টানেল

অর্থনীতিতে খুলবে নবদিগন্ত

যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষা। কাজ শেষ হয়েছে ৯৩ শতাংশ। শেষ মুহূর্তে চলছে বৈদ্যুতিক সিস্টেমের কাজ। আগামীকাল শনিবার টানেলের দক্ষিণ পাশের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এই টানেল চালুর পর কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাবে, যা দেশের প্রবৃদ্ধিতে অনন্য অবদান রাখবে। চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন মডেলের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই সিটি দক্ষিণ চট্টগ্রাম আর বন্দর নগরীকে। টানেলকে ঘিরে পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা, প্রবৃদ্ধি অর্জনে খুলবে নতুন দিগন্ত। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন এপাড়-ওপাড় করতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিট। এতে বাঁচবে সময়। ঘুচবে যাতায়াতের সময়ক্ষেপণ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। বর্তমানে কর্ণফুলী টানেলের সংশোধিত নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। নতুন করে ৭০০ কোটি টাকা বেড়ে টানেলের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পের প্রথম ডিপিপি প্রণয়নকালে খরচ ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। এখনো উদ্বোধন না হলেও চালুর প্রস্তুতি হিসেবে কর্ণফুলী টানেলের ভেতরে নির্মাণ সরঞ্জাম বোঝাই ট্রাক, পিকআপ কিংবা প্রকৌশলীদের বহনকারী মাইক্রোবাস চলাচল করছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে স্বপ্নের এ টানেল গিয়ে মিলেছে দক্ষিণের আনোয়ারা প্রান্তে। এখন চলছে টানেলের ভেতরে ফায়ার ফাইটিং, লাইটিং ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার কাজ। পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে প্রকল্পের গাড়িও। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনো সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচপাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

গত শনিবার চট্টগ্রামে পতেঙ্গা প্রান্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পরিদর্শন করেন টানেল। গাড়ি বহর নিয়ে ঘুরে দেখেন নানা স্থাপনা। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু টানেলে কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি বন্দরসহ দুই কূলের শিল্পকারখানা আর অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। বাড়বে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।

বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ জানান, প্রায় শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ। বর্তমানে টানেলের ভেতরে সিভিল কাজ শেষ পর্যায়ে। সেই সঙ্গে গাড়ি চলাচলের জন্য সড়কের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। হারুনুর রশিদ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে নভেম্বরেই শেষ হবে টানেলের সিভিল অংশের কাজ। এখন চলছে টানেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইলেকট্রো মেকানিক্যালের কাজ। চলমান কাজ শেষ করতে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগবে। প্রকল্প পরিচালক জানান, জানুয়ারির মধ্যেই সব কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত টানেল ব্যবহার উপযোগী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্বোধনের তারিখ নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সরকার যেটা ভালো মনে করবে, সুবিধাজনক সময়ে উদ্বোধন করা হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এরই মধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেলকে ঘিরে পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতি গতি পাবে।

টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল অর্থনীতি, যোগাযোগ এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক অবদান রাখবে। বিশেষ করে এটি হবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেওয়ার রোডম্যাপ। টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে টানেল।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ বলেন, ‘টানেল চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতিতে দারুণ অবদান রাখবে। টানেলের সড়ক এক সময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। এমন মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কিছু দিন পর সমুদ্রের পাড়ে বেটার্মিনাল চালু হবে। সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মযজ্ঞ হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে থাকবে যার প্রভাব নগরীতে পড়বে। টানেলের অপর প্রান্তে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে জনসমাগম। সেইসঙ্গে বাড়বে যানবাহনের চাপ। এসব কারণে নগরীকে নতুনভাবে সাজানোর কাজ চলছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close