নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

রাজধানীতে নির্বিঘ্নে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা

মহাসড়কে নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানীতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব যান চলাচল বন্ধে নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টের। অলিগলি থেকে শুরু করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কেই নির্বিঘ্নে চলছে এই বাহন। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি।

রাজধানী ঢাকা নগরীর সড়ক ও পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে এর সুফল মিলছে না। ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, শাহবাগ, মতিঝিল, পল্টন এলাকায় চলছে এই অটোরিকশা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশই ঘটে ব্যাটারিচালিত রিকশায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অবৈধ যান চলছে কীভাবে?

অনুসন্ধানে জানা যায়, পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে আছে স্থানীয় নেতা, চাঁদাবাজ, এমনকি পুলিশও।

ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা বলছেন, তারা মাসোহারা দিয়ে একটি করে টোকেন নিচ্ছেন, এরপর নির্বিঘ্নে চালাচ্ছেন এই অবৈধ যান। ‘সেভেন স্টার’, ‘ম’, ‘শাপলা’, ‘কদম ফুল’, ‘ধানের শীষ’, ‘নৌকা’ ইত্যাদি সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাদের। প্রতি মাসে টোকেন বাবদ ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা নেওয়া হয়। এই অনিয়মের পেছনে আছে পুলিশও। টোকেন দেখাতে পারলে পুলিশ কিছুই বলে না। আর টোকেন না থাকলে জব্দ করে নিয়ে যায় রিকশা। একেকটি রিকশা ছাড়িয়ে আনতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়।

এদিকে, করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের ব্যবস্থা করাসহ নতুন করে আরো আট দফা সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এই অবস্থার মধ্যেই চলছে বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক।

ব্যবসায়ীরাসহ যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে কমপক্ষে ২০ লাখ এমন পরিবহন চলছে। যা ২০১৬ সালের ছিল ১০ লাখ। ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে চলছে এসব যান। বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, সারা দেশে দিনে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পেছনে।

২০১৬ সাল থেকে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনের ওপর গবেষণা করছেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান। তিনি জানান, দেশে প্রায় ২৯ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট। একটি ইজিবাইকে ৪-৫টি ব্যাটারি থাকে। ১২ ভোল্টের প্রতিটি ব্যাটারির জন্য ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ ওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।

রাজধানীর আহাম্মদবাগ এলাকার দারোগার বাড়ির মোড়ের গলিপথে বেশ কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ। এ রকম গ্যারেজের কমতি নেই পাশের মহল্লা থেকে শুরু করে মুগদাপাড়া, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, বাসাবোসহ খিলগাঁও এলাকায়। এ অটোরিকশাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবসা করছে। মূলত লাভবান হচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে যারা এ ব্যবসা করছে। তারা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাটারি চার্জের জন্য বিদ্যুতের বিশেষ লাইন নামিয়ে চার্জের ব্যবসা করছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক সাইদুর বলেন, ঢাকায় চালানো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চালাচ্ছি। অনেক সময় পুলিশ জরিমানা করে রেকার বিল করে। তারপরও এসব মিটিয়েই চালাতে হয়, তা না হলে ছেলেমেয়েদের খাবার জোটাবো কীভাবে।

সম্প্রতি বিনা নোটিসে বিদ্যুৎ সংকটের কারণে জনগণ এক প্রকার অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তবে লোডশেডিংয়ের জন্য রাজধানীবাসী এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইককে দায়ী করছে। এছাড়া স্থানীয়রা এসব যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

অন্যদিকে, ব্যাটারিচালিত সহজ বিধায় এসব পরিবহনের বেশির ভাগ চালক শিশু। যাদের অধিকাংশের বয়স হলো ১৮ বছরের নিচে। তারা হলো শিশুশ্রমের আওতাভুক্ত। যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ব্যাটারিচালিত বিধায় তারা এসব পরিবহন অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যার কারণে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই মারা যাচ্ছে আবার অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভেতরে মোটরচালিত, মেশিনচালিত, ইঞ্জিনচালিত কিংবা ব্যাটারিচালিত সব ধরনের যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৭ সালেও একবার উচ্চ আদালত সড়কে অনুমোদনহীন বা তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এর জন্য নগরবাসীর সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।

আতিকুল ইসলাম বলেন, আজ প্রতিটি রাস্তা-মহল্লায় অটোরিকশায় সয়লাব। একেকটা অটোরিকশায় চারটি করে ব্যাটারি থাকে। সারা দিন চালানোর পর এগুলো সারা রাত ধরে চার্জে রাখা হয়। এই অটোরিকশাগুলো বিদ্যুৎ বিধ্বংসী। এতে প্রচুর বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি এগুলোতে প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটছে।

মেয়র বলেন, এরই মধ্যে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক কমিয়ে এনেছি। প্রয়োজনীয় বাতি ছাড়া সব বন্ধ থাকছে। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করলে চালকদের কষ্ট হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, শহরে আগে প্রচুর পায়ে চালিত রিকশা চলত। এখনো চলে। আমরা তো পায়ে চালিত রিকশা বন্ধ করে দিচ্ছি না। যে অটোরিকশা চালাত সে পায়ে চালিত রিকশা চালাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close