জিয়াউদ্দিন রাজু

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ছাত্রলীগের কার্যকলাপ নিয়ে সমালোচনা আরো চাউর

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কার্যকলাপ নিয়ে যে সমালোচনা ও বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে, তা অবসানের বদলে আরো বেশি চাউর হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কমিটি বাণিজ্য, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শাখা কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে। এর জন্য ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার অদক্ষতাকে দায়ী করছে খোদ সংগঠনেরই একাংশ।

ছাত্রলীগ নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে বিব্রত হচ্ছে ছাত্রলীগের অভিভাবক আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। এজন্য অবিলম্বে সম্মেলন দাবি এবং বর্তমান কমিটির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের দাবিও করছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ।

সংগঠনের সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ কমিটির অনেক নেতা। অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ‘জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক’ লিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এতে ঠিকমতো মূল্যায়ন না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। যোগ্যতার মাপকাঠি বিবেচনা না করে কমিটি দেওয়া, সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই মাস অন্তর নির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র একটি সাধারণ সভা হয়েছে। কাউন্সিলর, কেন্দ্রীয় কমিটি, সম্পাদকমণ্ডলীর সভা হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলোর দেখা মেলেনি। গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ৩০১ সদস্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এর বাইরে গিয়ে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে একাধিক অভিযোগও জমা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সোহান খান বলেন, ‘বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জয়-লেখকের সময়ের মধ্যে যতগুলো জেলা-উপজেলায় কমিটি ঘোষণা হয়েছে, এর মধ্যে ৯৯ ভাগ কমিটি নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। অছাত্র, জামায়াত-শিবির এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবারের সদস্য দিয়ে কমিটি করছেন তারা। কমিটি বাণিজ্যের বিষয় সবার মুখে মুখে। তাদের দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ চলতে পারে না। তারা সব দিকে ব্যর্থ।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখন সংগঠনকে বাঁচাতে হলে সম্মেলনের মাধ্যমে যোগ্য নেতাদের দায়িত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। তাছাড়া ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ নেই। তারা এমনিতেই দায়িত্বে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আমাদের সংগঠনের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সিদ্ধান্ত নেবেন।’

সংগঠনের আরেক সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের সুনির্দিষ্ট একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সেই গঠনতন্ত্র মেনে চলছেন না। তারা ছাত্রলীগকে নিজেদের বলয় কাজে ব্যবহার করছেন। যেটা সংগঠনের জন্য অশোভনীয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সম্মেলন দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বর্তমান সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে বারবার অবহিত করার পরও তারা আমাদের কথায় পাত্তা দিচ্ছেন না। নেতৃত্ব বিকাশের পথ যেভাবে নষ্ট হচ্ছে অবিলম্বে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতা নির্বাচন করা প্রয়োজন। এভাব একটা সংগঠন চলতে পারে না। নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী) দেশে ফিরলে আশা করি কার্যত পদক্ষেপ নেবেন।’

শুধু বর্তমান কমিটির নেতারাই নন, সাবেক ছাত্রনেতারা জয়-লেখকের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। তারা বলছেন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ থেকে সংগঠনের উত্তরণের কোনো পথ নেই। বিতর্কিত যেই হোক লাগাম টেনে ধরতে হবে। সেটি সম্ভব না হলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।

সম্প্রতি ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের দুই গ্রুপের কর্মকাণ্ডে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ইডেনের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। এতে রিভার বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের জোর করে নিয়ে যাওয়া, সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিন থেকে চাঁদা দাবি ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার রাতে ইডেন মহিলা কলেজে সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে।

ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর থেকেই ক্যাম্পাসে অস্থিরতা চলছে। আধিপত্য, হল দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে নতুন কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হলের ছাত্রীদের কটূক্তি ও অশালীন বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। শুধু অশালীন বক্তব্যই নয়, নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। এনিয়ে ইডেনে ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়েছ এবং ১৬ জন নেত্রীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কৃতরা এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তারা বলছেন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জয়-লেখকের নিজেদেরই মেয়াদ নেই। তারা বহিষ্কারের অধিকারও হারিয়েছেন। এক গ্রুপের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশের ইন্ধনে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগে এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অন্য গ্রুপ বলছে, অযোগ্যদের দিয়ে নেতৃত্ব হয় না। বর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা শুধু বিতর্কেই থাকেন। এ ছাড়াও ইডেন কলেজের তদন্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি তিলোত্তমা শিকদার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশিকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। তাদেরও ইডেন কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।

শুধু ইডেন কলেজ নয়, দেশজুড়ে বেশ কিছু শাখা কমিটিতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গঠিত রাজশাহী কলেজ মুসলিম হল ছাত্রদলের কমিটিতে ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রশিবির করতেন বলে কথিত আছে। অভিযোগ আছে, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জয়ের মায়ের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ছাত্রশিবির করা রানা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পেয়েছেন। এ ছাড়া জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমির মাদক গ্রহণের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক শেখ শামীম তূর্য, উপ-আইন সম্পাদক আপন দাস এবং সহসম্পাদক তানভীর আব্দুল্লাহ। তারা তদন্ত করতে গিয়ে উৎকোচ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়। এতে সভাপতি হন ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়। আরাফাতের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির নিচতলায় অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ওই বছরের ৩০ মার্চ তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন তাকে বহিষ্কার করেন। সেই বিতর্কিত নেতাই আবার শীর্ষপদে থাকায় কর্মীরা ক্ষুব্ধ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বরাবরের মতোই নিজেদের পক্ষে সাফাইগান। তিনি বলেন, একটি পক্ষ বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করতে লেগেই থাকে। তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে থাকতে পারে। সম্মেলনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই নির্দেশ দেবেন, আমরা সম্মেলন করব। প্রস্তুতি রয়েছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close