নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

খুলনা থেকে নিখোঁজ ছিলেন ২৯ দিন

নাটকীয়তার পর ফরিদপুরে উদ্ধার রহিমা বেগম

খুলনার নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ রহিমা বেগমকে ২৯ দিন পর ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এরপর থেকে তিনি ‘নির্বাক’ রয়েছে জানিয়ে পুলিশ বলছে, রহিমাকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কোনো কথা বলছেন না। তাকে উদ্ধারের সময় তার সঙ্গে ব্যাগভর্তি কাপড় ও অলঙ্কার ছিল। রহিমাকে অপহরণ করা হয়নি। তিনি নিজেই পালিয়ে ছিলেন।

শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকালে রহিমা বেগমকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে উদ্ধার পুলিশ। পরে ওই রাতেই তাকে খুলনা নিয়ে আসা হয়। এরপর গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়ায় নিজ বাড়ির উঠানে পানি আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন রহিমা বেগম। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে একটি অপহরণ মামলা করেন। ওই মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরপর মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করে আসছিলেন তার সন্তানরা। এছাড়াও শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ময়মনসিংহের ফুলপুরের বওলা গ্রামের ঝোপ থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারীর মরদেহ নিজের মায়ের বলে দাবি করেছিলেন রহিমার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। অবশেষে নানা নাটকীয়তার পর শনিবার ফরিদপুর থেকে জীবিত উদ্ধার করা রহিমা বেগমকে।

রহিমাকে উদ্ধারের পর শনিবার রাত ২টার দিকে খুলনা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করা হয়। রহিমা ওই বাড়িতে বসে দুজন নারীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। তাকে উদ্ধারের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুদ্দুসের ছেলে আলামিন, কুদ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের স্ত্রীকে আটক করা হয়েছে।

রহিমা বেগম নিখোঁজের মামলাটি প্রথমে জেলা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত দায়িত্ব নেয়। তবে পিবিআইয়ের পাশাপাশি পুলিশ ছায়া তদন্ত চালিয়ে যায়। রহিমাকে উদ্ধারের ঘটনায় রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের হাজী মহসিন রোডে পিবিআই খুলনার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রহিমাকে উদ্ধারের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কোনো কথা বলছেন না। কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। তবে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তার কাছ থেকে সাদা রঙের একটি শপিং ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ওড়না ছিল, হিজাব ছিল, আয়না, শাড়ি, আইড্রপ, ওষুধ ছিল। তার পরিধেয় সালোয়ার কামিজ ছিল, সঙ্গে ছোট একটি অর্নামেন্টাল পার্টস ছিল। স্বাভাবিকভাবে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে এই জিনিসগুলো থাকার কথা নয়। তবে আপাতদৃষ্টিতে এটা অপহরণ নাও হতে পারে।’

রহিমা বেগম কিছুটা ‘নার্ভাস’ অনুভব করছেন জানিয়ে পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান বলেন, রহিমাকে বিশ্রামে রাখা হয়েছে। তিনি একটু স্বাভাবিক হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তার নিখোঁজের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হবে।

রহিমা বেগমের নিখোঁজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া ময়মনসিংহে অজ্ঞাতনামা নারীর মরদেহকে নিজের নিখোঁজ মা রহিমা বেগমের বলে দাবি করায় প্রশাসন বিভ্রান্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন পুলিশ সুপার।

এর আগে সকালে রহিমা বেগমকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে নেওয়ার সময় দৌলতপুর থানার উপপরিদর্শক দোলা দে বলেন, রহিমা বেগম তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি সন্তান ও স্বামীর কাছে যেতে চান না। তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান সকালে দেখা করতে এলেও দেখা করতে চাননি রহিমা। পরে দেখা বলেও রহিমা বেগম তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

২৯ দিন কোথায় ছিলেন রহিমা

রহিমা বেগমের আশ্রয় নেওয়া ফরিদপুরের বাড়ির মালিক কুদ্দুস বেশ কয়েক বছর আগে খুলনার সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন। তখন রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পরে তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতের চলে যান। জিজ্ঞাসাবাদে ওই বাড়ির লোকজন পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রথমে রহিমা বেগমকে তারা চিনতে পারেননি। পরে তাকে চিনতে পেয়ে সাবেক বাড়িওয়ালা হিসেবে তারা সেবাযত্ন করেছেন। রহিমা তাদের জানিয়েছিলেন, রহিমা বেশ কয়েক দিন চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ছিলেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর বোয়ালমারীর কুদ্দুসের বাড়িতে যান। তখন তার একটি ব্যাগে দুই প্যাকেট বিস্কুট, কিছু কাগজপত্র ও পরনের কিছু কাপড়-চোপড় ছিল।

খুলনা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রহিমার কাছে কোনো মোবাইল ফোন ছিল না। সে কারণে ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। রহিমা অপহরণ মামলাটির তদন্ত দৌলতপুর থানা-পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইতে গেছে। তারপরও খুলনা মহানগর পুলিশ মামলাটির ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল।

রহিমা আসলেই অপহরণ হয়েছিলেন নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন- এমন প্রশ্নের মোল্লা জাহাঙ্গীর বলেন, তিনি কোনো জবাবই দিচ্ছেন না। খাবারও খেতে চাইছেন না। তবে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলছেন। মামলাটি যেহেতু পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্ত করছে, তারাই বিস্তারিত উদ?ঘাটন করবে। তবে তাকে যে বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাবাসাদে জানা যায়, তিনি চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ও সর্বশেষ ফরিদুপর ছিলেন।

আইনি ব্যবস্থা চান অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনরা

খুলনার দৌলতপুর থেকে রহিমা বেগম নিখোঁজের পরদিন মেয়ে আদুরী আক্তার থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। সেই মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাদের ঘায়েল করার জন্য ওই মামলা করা হয়েছিল। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে আত্মগোপন করেছিলেন রহিমা। বিষয়টি জানতেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ পরিবারের সদস্যরা।

খুঁজে পাওয়া রহিমা বেগম ও তার মেয়েদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মামলায় গ্রেপ্তার হেলাল শরীফের পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন তারা। রবিবার সকালে হেলাল শরীফের স্ত্রী মনিরা আক্তার বলেন, ‘মরিয়ম মান্নানের সৎভাইয়ের কাছ থেকে ২০১৯ সালে জমি কিনেছিলাম। কিন্তু সেই জমির দখল তারা দেয়নি। এ জন্য সেখানকার স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে আমরা আবেদন করেছিলাম। তবে ওই পক্ষ এগোয়নি। বরং আমাদের নামে মানহানি মামলাও করেছিল। সেই মামলায় আমার স্বামীসহ পাঁচজন আসামি ছিলেন। সবাই আগাম জামিন নেন। পরে সেই পাঁচজনের নামে অপহরণ মামলা করা হয়েছে। আগের মামলায় জামিন হওয়ার পরই নতুন করে ফাঁসানোর জন্য তারা অপহরণের ঘটনা সাজায়।’

রহিমা নিজে আত্মগোপন করেছিলেন, এটা এখন পরিষ্কার বলে মনে করেন মনিরা আক্তার। তিনি বলেন, ‘শুধু ফাঁসানোই টার্গেট ছিল। মরিয়ম মান্নান সবকিছুই করল। অকারণেই আমাদের দিকে আঙুল তোলা হলো। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, গ্রেপ্তার কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আমার স্বামী বের হলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমরা আশা করছি, দ্রুত আমার স্বামী ছাড়া পাবে।’

অপহরণ মামলায় স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সামাজিকভাবে অনেক হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে মনিরা আক্তারকে। থানা-পুলিশ ও আদালতে ছোটাছুটি করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে বলে জানিয়েছেন মনিরা। তিনি বলেন, গত ৩০ আগস্ট তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ৬ সেপ্টেম্বর তার কন্যাসন্তান হয়েছে। ১৩ অক্টোবর সন্তান প্রসবের নির্ধারিত দিন ছিল। কিন্তু স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আগেই সিজার করতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি স্বামীকে কাছে পাননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close