মিজান রহমান

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছে জাপা

দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ সংকট জটিল হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে দুইপক্ষের উত্তাপে শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশ বিরাজ করছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে উদ্ভূত এ পরিস্থিতি কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছেন জাপার শীর্ষ নেতারা। নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে জাতীয় পার্টিতে দুটি বলয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরে শীর্ষ নেতাদের পদক্ষেপে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিতে থাকেন রওশন এরশাদ। আর জাপার প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের ভাই জি এম কাদের দলের নেতৃত্ব দিয়ে যান। এরপর জি এম কাদের রওশনকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সংসদে হন বিরোধীদলীয় উপনেতা। সেসময় জি এম কাদের ও রওশনের মধ্যে যে মীমাংসা হয়, সে অনুসারেই সবকিছু চলছিল। তবে সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে গিয়ে দলের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হন রওশন এরশাদ। জি এম কাদের এবং তার অনুসারীরা তার খোঁজ না নেওয়ায় গত ২ জুলাই দলের একটি মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রওশন। সভায় দলে এরই মধ্যে কোণঠাসা নেতারা উপস্থিত থাকলেও জাপার মূল দলের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। রওশনের এই অসন্তোষের সুযোগ নেয় একটি পক্ষ। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দল চালানোর কথা বলেন তারা। এ নিয়ে শুরু হয় নতুন দ্বন্দ্ব।

ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন হঠাৎ করেই আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল ডাকেন। এরপর তাকে সরিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য সংসদের স্পিকারকে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলায় প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ দলের সব পদপদবি থেকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি এবং পরবর্তীতে রংপুর জেলা কমিটির সভাপতির পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। স্পিকারকে দেওয়া চিঠি প্রত্যাহারের জন্য রাঙ্গার আবেদন- সব মিলিয়ে বহুমুখী সংকট ও নাটকীয়তা বাড়ছে দলটিতে। চলমান উত্তাপের মধ্যেই জি এম কাদেরকে কড়া ‘আদেশ’ করে চিঠি দিয়েছেন রওশন। এ নিয়ে এখন চলছে নানা তর্কবির্তক। তবে কেউই চান না দল ভাঙনে পড়ুক। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, সে উপায় খুঁজছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

দলীয় সূত্র জানায়, রওশন গত শনিবার জি এম কাদেরকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সে চিঠিতে কার্যত জাপার গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রওশন ও তার অনুসারীরা। তারা অভিযোগ তুলে বলেছেন, দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে যে গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়েছিল, সেটিতে ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে রওশনকে কিছু সাংগঠনিক ক্ষমতা দেওয়া ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সেই গঠনতন্ত্র পাল্টে ফেলা হয়েছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি তার অবর্তমানে ভাঙনের মুখে পড়ুক, তা চান না রওশন এরশাদও। তার ঘনিষ্ঠ দলীয় এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আসলে বিষয়টি শুধুই ভুল বোঝাবুঝি। জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে থাকুক, এটা বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদও চান। তবে জাপার বিগত কাউন্সিলে যে গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়েছে, সেখানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রওশন এরশাদকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে; সেটির বাস্তবায়ন চান। সেখানে রয়েছে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রওশন এরশাদের সঙ্গে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সোজা কথা দেবর জি এম কাদের যদি ভাবির পরামর্শে দল চালান; তাহলে এই সংকট কেটে যাবে। মূল কথা এখন সংকট উত্তরণে জি এম কাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

এ সময় তিনি আরো বলেন, সংসদ সদস্যরা নীরব থাকলে অধিকাংশ সংসদ সদস্য রওশনের পক্ষে চলে যাবেন। তারা অপেক্ষায় আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন জাপা দলীয় সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমরা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে জিম্মি। দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে দেওয়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে আমরা কথা বলতে পারি না। অনেক এমপি রওশন এরশাদের পক্ষে কথা বলতে চাইলেও দল থেকে বহিষ্কারের ভয়ে কথা বলেন না।’

তিনি বলেন, ‘আসলে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ধারা-উপধারা বাতিল এখন লাখ লাখ পল্লীবন্ধু কর্মী-সমর্থকদের সময়ের দাবি।’

দলের পদপদবি খোয়ানো মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘জাপার বিগত কাউন্সিলে যে গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়েছে সেখানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রওশন এরশাদকে বেশকিছু ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। তবে পরবর্তীতে কে বা কারা সেই গঠনতন্ত্র পাল্টে ফেলেছেন, যেখানে রওশন এরশাদের কোনো ক্ষমতা রাখা হয়নি। দুটো গঠনতন্ত্রই আমার কাছে রয়েছে; একটিতে রওশনের ক্ষমতা, অন্যটিতে জি এম কাদেরের ক্ষমতা। একটি দলের তো দুটি গঠনতন্ত্র থাকতে পারে না। এভাবে একটি পার্টি চলতে পারে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র ও ২০ ধারা নিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গার কথা বলা স্ববিরোধী। তিনি বলেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই ধারা ব্যবহার করে সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব করেছিলেন। তখন তিনি গঠনতন্ত্রের ওই ধারার সুবিধাভোগী হয়েছেন। তখন তো মসিউর রহমান রাঙ্গা গঠনতন্ত্রের এই ধারার বিরোধিতা করেননি।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘রওশন এরশাদকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তৃতীয় একটি পক্ষ সুবিধা করার চেষ্টা করছে; যা আমাদের দলের চেয়ারম্যানও বলেছেন। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারবে না।’

তৃতীয় পক্ষ বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা ওনার (রওশন) পাশেই থাকেন। উনি দেশে এসে হোটেল ওয়েস্টিনে যে সভা করছিলেন, সেই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারাই হলেন সেই তৃতীয় পক্ষ।’

এদিকে জাতীয় পার্টির এ পরিস্থিতি তেমন কোনো সংকট নয় দাবি করেছেন দলের কো-চেয়ারম্যান সিনিয়র সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি বলেন, ‘এখন যা ঘটছে তা দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি কোনো সংকট নয়, জাপার সংকট সব কেটে গেছে। জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে, সামনেও থাকতে হবে। যা হয়েছে তা শিগগিরই কেটে যাবে।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ পার্টির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু করছেন বলে বিশ্বাস করি না। তবে ম্যাডাম তার ছেলে ও আরো দু-একজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদের যে চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেই চিঠি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। কোনো ষড়যন্ত্রই জাতীয় পার্টির ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close