নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ট্যানারির বর্জ্যে পশুখাদ্য তৈরি থামছেই না

* জনস্বাস্থ্য হুমকিতে * গোপনে সাভার ট্যানারির বর্জ্য খামারে বিক্রির অভিযোগ

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ট্যানারি বর্জ্য থেকে পোলট্রি ও মাছের খাদ্য তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যেই ট্যানারির বর্জ্য জ্বালিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিষাক্ত পোলট্রি ফিড। আর এসব ফিড সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকার পশু, পোলট্রি ও মাছের খামারে। এসব ফিডে আছে ট্যানারির চামড়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ক্রমিয়াম, সালফিউরিক অ্যাসিড, লাইম, সোডা, ফরমিকা, ক্লোরাইড, সালফেট, অ্যালুমিনিয়াম সালফেট প্রভৃতি। এসব বিষাক্ত উপাদান মুরগি ও মাছের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে মানব-শরীরে। এতে জনস্বাস্থ্য রয়েছে হুমকিতে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, চামড়া কারখানায় ব্যবহৃত সালফিউরিক অ্যাসিড, ক্রোমিয়াম এবং সিসা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তার ওপর এসব কারখানায় কোনো বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’-ও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়াশিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

এসব জেনেও সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট থেকে কঠিন বর্জ্য নিয়মিত একটি চক্র অবৈধভাবে বের করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবৈধভাবে বের করা এসব কঠিন বর্জ্য নেওয়া হচ্ছে পশু, পোলট্রি ও মাছের খাদ্য তৈরির কারখানায়। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের সলিড ওয়েস্ট ডাম্পিং স্টেশনে গেলে পরিবহন শ্রমিকরা এ তথ্য জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, নিয়মিত একটি চক্র গভীর রাতে ও ভোরবেলা ট্রাকবোঝাই করে কঠিন বর্জ্য সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের পেছনের গেট ও ১ নম্বর গেট দিয়ে বের করে নিয়ে যায়। সেগুলো দেশের বিভিন্ন পশু, পোলট্রি ও মাছের কারখানায় বিক্রি করা হয়। এ চক্রের সঙ্গে ট্যানারির কিছু নিরাপত্তাকর্মী, কর্মচারী ও স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা জড়িত।

অপর এক শ্রমিক জানান, বৃহস্পতিবারও বিষাক্ত বর্জ্যবোঝাই দুটি ট্রাক অবৈধভাবে বের হওয়ার সময় আটক করেছে ট্যানারি কর্তৃপক্ষ।

ওই শ্রমিকের অভিযোগের পর ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের বাউন্ডারির ভেতরে জব্দ করে রাখা ঢাকা মেট্রো ড ১৪-৬০৪৭ ও ঢাকা মেট্রো ড ১২-১২৭১ নম্বরের দুটি ট্রাক দেখা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, এ ট্রাক দুটি কঠিন বর্জ্য নিয়ে বের হওয়ার সময় জব্দ করা হয়েছে। আমরা মাঝেমধ্যেই এরকম ট্রাক জব্দ করি। পুলিশেও দেই। কিন্তু, পুলিশ ছেড়ে দেয়। এই কঠিন বর্জ্য দিয়ে পোলট্রি-পশুখাদ্য তৈরি করা হয়। বিষয়টি বন্ধ করা দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী সতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, আমরা মাঝেমধ্যেই কঠিন বর্জ্যবোঝাই ট্রাক বের হওয়ার সময় আটক করি। মাঝেমধ্যে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পুলিশ ফাঁড়িতেও দেওয়া হয়। আমরা এ চক্রটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চাই। তা ছাড়া এই চক্রটিকে প্রতিহত করা যাবে না। আগামী বোর্ড মিটিংয়ে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব এবং একটা সিদ্ধান্তে আসব।

বিষয়টি জানতে চাইলে চামড়া শিল্প নগরী ট্যানারি ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. রাসেল মোল্লা বলেন, আমাদের কাছে শুধু একটি ট্রাক হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু, ট্যানারি কর্তৃপক্ষ ট্রাকটির বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়ায় পরবর্তীতে ডাম্পিং স্টেশনে ওই বর্জ্যগুলো আনলোড করে ট্রাকটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তো ট্রাক আটক করার কেউ না। ট্যানারি কর্তৃপক্ষ ট্রাক আটক করে মামলা দিলে আমরা মামলা নেব।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় সাভারের চামড়াশিল্প নগর বন্ধ করে দিতে গত বছরের আগস্টে সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। তবে সে সুপারিশ পুরোপুরি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কমিটি মনে করে শিল্প মন্ত্রণালয় ইচ্ছা করে সময়ক্ষেপণ করছে। কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে ট্যানারি চলতে পারে না। কমিটির বৈঠকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।

সূত্র জানায়, সাভার এলাকায় তিনটি পোলট্রি ফিড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ১ লাখ ৫ হাজার টন ট্যানারি বর্জ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাভারের ভার্কুতাতেই এক লাখ টন, আমিনবাজারে দুই হাজার টন ও ভার্কুতা মোগড়াকান্দায় তিন হাজার টন বর্জ্য পাওয়া যায়। রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে ঘিরে এর আশপাশে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বিষাক্ত পোলট্রি ফিড তৈরির কারখানা। এখন এসব ট্যানারি রয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে। হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হরিণধরা গ্রামে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্প নগরীর একেবারে উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বর্জ্য পোড়ানোর খামারগুলো। বর্জ্য পোড়াতে সেখানে প্রায় ৪০টির মতো চুলা রয়েছে। আর সেখানেই তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত পোলট্রি ফিড।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ডিএলএস) ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পোলট্রি ফিডে ট্যানারি বর্জ্য দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। নিয়মিত সম্মিলিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। পোলট্রি ফিডে ট্যানারির বর্জ্য মেশানোর অপরাধে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত পোলট্রি ফিড। এ বাজারে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। পোলট্রি ফিডের প্রধান উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিন, এর ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাকি অংশ আর্জেন্টিনা, ভারত ও ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল মাছ, মুরগি ও পশুখাদ্য তৈরিতে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছিলেন আপিল বিভাগ। ওইদিন শিল্প মালিকদের করা আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন খারিজ করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধী চার সদস্যর বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পোলট্রি ও মাছের খাবার প্রস্তুতকারক সমিতির করা আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছে। ওই আদেশের ফলে ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে মুরগি ও মাছের খাবার তৈরি বন্ধে আগের রায়ই বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন মনজিল মোরসেদ।

এর আগে ২০১০ সালের ২৬ জুলাই পরিবেশবাদী সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে জনস্বার্থে করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২১ জুলাই এক মাসের মধ্যে ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে মাছ, মুরগি ও পশুখাদ্য তৈরির কারখানা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। পরে এর বিরুদ্ধে একটি কারখানার মালিকের করা লিভ টু আপিলও খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close