মেহেদী হাসান, ঢাকা

  ০৩ আগস্ট, ২০২২

ডলার পতন, রাশিয়া চীনের মেরূকরণ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; রিজার্ভ কারেন্সিতে চলে আসা ডলারের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। একে ডলারের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধও বলা যেতে পারে

সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে রাশিয়ার হাতে। সামরিক শক্তি বিবেচনায় দেশটি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। খাতাণ্ডকলমে বিবেচনা করলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য ইউক্রেন দখল করাটা কেবল ইচ্ছার ব্যাপার। কারণ রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেন শক্তিতে অনেক পিছিয়ে। আর চলমান যুদ্ধে রাশিয়া তাদের শক্তির এক-তৃতীয়াংশও প্রদর্শন করেনি।

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি চেচনিয়ার শাসক রমজানকে ইউক্রেন দখলের হুকুম দেন তাহলে ইউক্রেনকে এক সপ্তাহের মধ্যেই দখল করতে পারবে চেচনিয়া- এমনটাই মনে করেন ওই অঞ্চলের সামরিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চেচনিয়ার যে সামরিক শক্তি তাতে ইউক্রেনকে অল্প সময়ের মধ্যে দখল করার ক্ষমতা তারা রাখে। প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে কেন রাশিয়া পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে ইউক্রেন দখল করে নিচ্ছে না। কি-ই-বা পরিকল্পনা করছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন!

পুতিনের পরিকল্পনা : পুতিনের আসল পরিকল্পনা ইঙ্গিত দিচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কিন্তু এই যুদ্ধ কোনো দেশ দখলের নয়। সাত দশক ধরে রিজার্ভ কারেন্সিতে চলে আসা ডলারের একক অধিপত্যের বিরুদ্ধে হচ্ছে এই যুদ্ধ। একে ডলারের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধও বলা যেতে পারে। এক সময় গোটা পৃথিবীর জন্য ডলার ছিল নিশ্চয়তার আরেক নাম, কিন্তু বর্তমানে তা বিষমুদ্রায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আফগানিস্তান হোক অথবা রাশিয়া, সময়ে অসময়ে নানা অজুহাতে পৃথিবীর যেকোনো দেশের রিজার্ভ কারেন্সি আটকে দিচ্ছে আমেরিকা। এভাবে তাদের বিপক্ষ দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার মাধ্যমে পৃথিবীতে একক অধিপত্য বজায় রাখতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। এক কথায় বর্তমানে তারা এই ডলারকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। পৃথিবীর বহু দেশ এখন তাদের এই নিষেধাজ্ঞার ভয়ে তটস্থ।

পুতিনের পরিকল্পনা হচ্ছে পৃথিবী থেকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ভয়কে নিশ্চিহ্ন করা। এ যুদ্ধে রাশিয়া একা নয়। পুতিনের পাশে আছে আরেক পরাশক্তি চীনও।

ইউক্রেন আক্রমণের সময় রাশিয়ার ৬০০ বিলিয়ন ডলার আটকে দেয় আমেরিকা। কিন্তু এই অর্থ আটকে যাওয়ার কথা আগে থেকেই জানতেন পুতিন। মূলত এ ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে পুতিন তার পরিকল্পনার প্রথম ছক এঁকেছেন। এর মাধ্যমে পুতিন সারা পৃথিবীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, আমেরিকার স্বার্থে আঘাত হানলে কারো অর্থই নিরাপদ নয়। মূলত এই সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা সারা পৃথিবীকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চায়। কারণ এর আগে আফগানিস্তান ও ইরানের ডলারও আটকে দেয় আমেরিকা।

অন্যদিকে চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ চরমে পৌঁছে গেছে। ডলারের বিরুদ্ধে বর্তমানে চীন-রাশিয়া দাঁড়ালেও আরো অনেক দেশ যে তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে তা অনেকটাই স্পষ্ট।

রুশ বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, চীনকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পুতিন গড়তে যাচ্ছে ইউরেশিয়া ইউনিয়ন।

ডলারের বিরুদ্ধে এর আগেও এমন পরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি। কিন্তু দুর্বল পরিকল্পনা ও শক্তিমত্তার অভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের।

তবে এবার যারা মাঠে নেমেছেন তারাও পৃথিবীর পরাশক্তি। চীন ও রাশিয়ার এক হওয়া নিঃসন্দেহে আমেরিকার জন্য চিন্তার বিষয়।

চীন-রাশিয়ার প্রস্তুতি

গত আট বছরে পুতিন তার মজুদে থাকা স্বর্ণের পরিমাণ তিনগুণ বাড়িয়েছেন, এর পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার টন। রাশিয়ার মুদ্রা রুবলকে অচল করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের থাকলেও স্বর্ণ অচল করা তাদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিন দুটি তালিকা করতে সক্ষম হয়েছেন। সেটি হলো কারা তার পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এর মাধ্যমে পুতিন স্পষ্ট হয়েছেন পরবর্তী পদক্ষেপে কোন দেশগুলো তাকে সমর্থন দেবে। যা আবারও তার দূরদর্শিতার প্রমাণ করে।

এরই মধ্যে পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন যারা তার পক্ষে, তারা চাইলে যেকোনো কারেন্সির মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে। আর যারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের জন্যও তিনি লেনদেনের ব্যবস্থা রেখেছেন। তবে তা শুধুই রুবলের মাধ্যমে।

রাশিয়ার এই পরিকল্পনা অল্প সময়ের মধ্যেই ফলপ্রসূ হয়। ইউক্রেন আক্রমণের সময় রুবলের দর কিছুটা পতন হলেও তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধকে পুঁজি করে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার যে পরিকল্পনা আমেরিকা করেছিল তা নিস্ফল করে দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপকেও বুঝিয়েছেন, আমেরিকার পক্ষে গেলে তেল, গ্যাস ও খাবারের অভাবে অচল হয়ে যাবে গোটা মহাদেশ।

অন্যদিকে বর্তমানে চীনের কাছে থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার পরিমাণ ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং চীন ও রাশিয়া যে তাদের পরিকল্পনায় সফল তা স্পষ্ট।

এখানেই শেষ নয়, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরানকে টিকিয়ে রাখার পেছনের হাতটাও রাশিয়া-চীনের। এর মাধ্যমে তারা সারা পৃথিবীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, চীন ও রাশিয়া কখনো দুঃসময়ে বন্ধুত্বের হাত ছাড়ে না।

এরই মধ্যে রুশ অর্থনীতিবিদরা বলেই দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। চীনকে সঙ্গে নিয়ে পুতিন গড়তে যাচ্ছেন ইউরেশিয়া অঞ্চল। যার মূল লক্ষ্য হবে ডলারের পতন ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে আমেরিকার ভয়কে চিরতরে দূর করা।

মোটকথা তারা রিজার্ভ কারেন্সিতে সুইফট ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন মুদ্রাব্যবস্থা আনতে যাচ্ছে। আর এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সফল হয়েছেন পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং।

২০১৮ সালে আমেরিকার আদেশ অমান্য করে রাশিয়ার কাছ থেকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য চুক্তি করেছে ভারত। যার লেনদেন করা হচ্ছে রুপি-রুবলে। শুধু বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নয়, কৃষিকাজে ব্যবহৃত সারও ভারতে আমদানি করা হচ্ছে রুপি-রুবলে।

এর মাধ্যমে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই ভারতকে রুবলের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। ফলে পুতিন ইঙ্গিত দিচ্ছেন পৃথিবী থেকে ওয়াশিংটন, লন্ডনকে ভেঙে মস্কো, বেইজিং ও নয়াদিল্লির রাজত্বের আগাম বার্তার।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা

যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে দেশটির শক্তিমত্তা সম্পর্কে পুরো ধারণা নেওয়া। দ্বিতীয়ত গোটা পৃথিবীকে দুই ভাগে বিভক্ত করা। যারা রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেবে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবরোধ দিয়ে নিজেদের বশে নিয়ে আসা। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা বিফল করে দিয়েছেন পুতিন।

পুতিন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন কিন্তু পুরো শক্তির ২০ ভাগও প্রদর্শন করছেন না। অপরদিকে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে উল্টো ইউরোপকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পরবর্তী পদক্ষেপে যদি তারা আমেরিকার পক্ষ নেয় তাহলে অচল করে দেওয়া হবে গোটা মহাদেশকে। সুতরাং আমেরিকা তাদের প্রথম পরিকল্পনায় ব্যর্থ।

ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে ইউরোপ সমর্থন দিয়েছে আমেরিকাকে কিন্ত তারা রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও খাদ্যের বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারেনি। সুতরাং রাশিয়া যদি সুইফটের বিকল্প ব্যবস্থা বের করে, সেখানে ইউরোপের দেশগুলো যে আমেরিকাকে বাদ দিয়ে রাশিয়া ও চীনের অনুকূলে সমর্থন দিতে পারে সেটাও অনেকটা স্পষ্ট। এরই মধ্যে হাঙ্গেরি এর ইঙ্গিত দিয়েছে। আর এটা হলে আমেরিকা গোটা পৃথিবীকে নিজেদের আয়ত্তে আনার যে পরিকল্পনা করেছিল তাও ব্যর্থ হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close