গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৭ জুলাই, ২০২২

অবক্ষয়ের মূল কারণ শিক্ষক রাজনীতি

* আদর্শ খুইয়ে শিক্ষকদের অর্থ ও প্রতিপত্তির প্রতি ঝুঁকে পড়া উচিত না * শিক্ষক-ছাত্র সম্প্রীতির বন্ধন পুনরুদ্ধার করা উচিত

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে। শিক্ষক-অভিভাবক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে সব কিছু ছাপিয়ে সামনে এসেছে শিক্ষকদের আর্থিক বিষয়ে নজর এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া।

সম্মানের জায়গা থেকে শিক্ষকদের আদর্শচ্যুত হওয়া, এক শিক্ষকের পেছনে অন্য শিক্ষকের লেগে থাকা এবং ক্ষমতাণ্ডপ্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ব্যবহার করে সাময়িক ফায়দা হাছিল করা।

শিক্ষকদের অনৈতিক চর্চার কারণে ছাত্রদের সঙ্গে তাদের সম্প্রীতির বন্ধন কমে যাওয়াই এই সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। যে কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষাঙ্গনে ঘটছে অনভিপ্রেত ঘটনা। শিক্ষার্থীর হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষকরা অন্যায় করলে তাতে শিক্ষার্থীদের নাক গলানো উচিত না বলেও মনে করছেন সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ বা তাদের হেনস্থ করা, শারীরিকভাবে নির্যাতন করা- এটা ছাত্ররা করতে পারে না। শিক্ষক যদি লাইনচ্যুত হয়ে যান ও নীতি-নৈতিকতা বজায় না রাখেন সেটা সমাজ দেখবে, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোনো অংশ হতে পারে না।এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমাদের বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা হচ্ছে- প্রতিপত্তি বা স্ট্যাটাসের জন্য কার কত অর্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে তা প্রদর্শন। যে কারণে আপনি একজন ভালো শিক্ষক, সৎ-জীবন যাপন করেন, নিয়ম মেনে চলেন এবং আইন মোতাবেক চাকরিতে কাজ করেন- এগুলো আজকাল নীতি বাক্যতে পরিণত হয়েছে। কারণ, আপনার অর্থ ও প্রতিপত্তি কোনোটাই নেই। সামাজিক প্রতিপত্তি বা মর্যাদা নির্ধারণে দুটোই নির্ণায়ক- একটি অর্থ এবং অন্যটি রাজনীতি।

তিনি বলেন, আপনার বাবা গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান আপনার নিয়ম মানার দরকার নেই। বিষয়টি এখন হয়ে গেছে এই রকম। কেননা সামাজিক ব্যবস্থায় যখন পুরোপুরি মূল্যায়নের মানদণ্ড তৈরি হয়; সেই মূল্যায়নগুলো একসময়ে ভেঙে যায়। এগুলো যখন রাজনীতিক ও সমাজিকভাবে নির্ধারণ (প্রমোট) করে দেয়া হয় তখন শিক্ষকদের কখনই শিক্ষার্থীরা মানবে না।

সামাজিক এই অবক্ষয়ের জন্য এখন অনেকেই বলে থাকেন শিক্ষকদের হাতে বেত নেই বলে এটা হচ্ছে। কিন্তু আমি ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। কারণ, দেখতে হবে একজন শিক্ষার্থী যখন ছোট ছিল ওই সময়ে পরিবার থেকে সে কি শিক্ষা পেয়েছিল এবং সে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে কি নীতি-নৈতিকতায় বড় হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের ভয়ে আড়ষ্ট থাকবেন সর্বদা শিক্ষার্থীরা- এটাও উচিত না। আমরা শিক্ষকরাও অনেকাংশে দায়ী। একজন শিক্ষক ক্লাসে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করছেন, এর পেছনে শিক্ষার্থীকে উসকে দিচ্ছেন ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকজন শিক্ষক অপরাজনীতি করে। অপরাজনীতিও আরেকটি কারণ। এসব করে আমরা শিক্ষকদের মর্যাদার আসন থেকে নিচে নামিয়ে ফেলেছি। নিজেকে নিজে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য শিক্ষকরা একজন অন্যজনের পেছনে লেগে থাকেন। আমি মনে করি উভয়ের (শিক্ষক-শিক্ষার্থী) দোষ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে আমাদের যে সামাজিক বাস্তবতা ও সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে সেই পরিবর্তনও অনেকাংশে দায়ী। সামাজিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না; যার জন্য এই ধরনের সমস্যাগুলো হচ্ছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. শহীদুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের অংশ। এটা কমিউনিটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সমাজ পরিবর্তনের কারণে এটা হয়। তবে শিক্ষকদের অনেক সময় ত্রুটি থাকে। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির মেরুকরণে নিজেকে সম্পৃক্ত করাও সামাজিক অবক্ষয়ের অংশ। কিন্তু শিক্ষাকতা মহান পেশা, তাদের শুধু শিক্ষার্থী নয়, অভিভাবক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সম্মান করেন। তবে তাদের ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলার ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন হয় সেখানে ব্যত্যয় ঘটে। তার মানে এই নয় শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ বা হেনস্থা করবে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করবে। এটা তো ছাত্ররা করতে পারে না। শিক্ষক যদি লাইনচ্যুত হয়ে যায় ও নীতি-নৈতিকতা না থাকে সেটা সমাজ দেখবে- এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোনো অংশ হতে পারে না।

সামাজিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের পথ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণ কঠিন। একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। এর জন্য সময় লাগবে। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হয়, কেউ তা রোধ করতে পারে না। তবে সমাজ পরিবর্তনের কারণেই এই সামাজিক অবক্ষয়। এটা রোধ করতে পারে পরিবার। তাদের নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া। বর্তমানে যদিও নতুন প্রজন্মকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তারপরও হতাশ হলেই চলবে না। একজন শিশুর পাঠশালা তার পরিবার। এরপর স্কুল-কলেজের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি জায়গা ঠিক থাকলে সামাজিক অবক্ষয়ের যে ধারা চলছে সেটার পরিবর্তন হওয়া সম্ভব।

জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এটা একটা জটিল প্রসঙ্গ। শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্ররা অন্তর্ভুক্ত হয় কিন্তু এর সঙ্গে শুধু তারাই জড়িত না। এর সঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষ থাকে, স্কুলের সঙ্গে জড়িত কিছু লোক থাকে, এর থেকে বোঝা যায় ছাত্ররা কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পেছন থেকে কেউ কেউ কলকাঠি নাড়ে। ছাত্রকে ব্যবহার করে মানুষের সেন্টিমেন্ট কাজে লাগায়। সাম্প্রতিক ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগানো হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। মানা-মান্যতা শুধু শিক্ষকের ক্ষেত্রে হবে কেন? সম্মান সবার জন্য হওয়াই শ্রেয়।

মনরোগ এই চিকিৎসক বলেন, শিক্ষকের কিছু ভূমিকা আছে; তবে প্রধান রোল বলা যাবে না। কোনো কোনো শিক্ষকের বাণিজ্যিক প্রবণতা রয়েছে; যেটা ছাত্রদের কাছে ধরা পড়েছে। তারা ওই শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষকের ইন্ধন থাকে। ফলে যিনি ইন্ধন দিচ্ছেন এবং যার বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হচ্ছে কারো প্রতিই শিক্ষার্থীদের সম্মান থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। এসব নানা অনৈতিক কারণে মূলত সামাজিক অবক্ষয় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও বলব শুধু শিক্ষকরাই দায়ী না; সামগ্রকিভাবে সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে এ থেকেই মানা-মান্যতা বোধ কমে যাচ্ছে। তবে একজন রোগী যখন আমার কাছে আসবে তখন আমি চিন্তা করব সে মানসিক অসুস্থ থেকে এটা করছে, না কি আচরণগত সমস্যা থেকে এটা করছে- সেটা নির্ণয় করা। কিন্তু সামাজিক প্রসঙ্গটি যখন আসবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বিবেচনা করা যাবে না। সমাগ্রিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই কিছুটা সামাজিক যে অবক্ষয় হয়েছে- এর থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটানো যাবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে- এটা তো বটেই। কারণ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, মমত্ববোধ এগুলো ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। অসিহষ্ণুতা সমাজের সর্বত্রই বিরাজ করছে। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণ এমনভাবে রূপ নিয়েছে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক হচ্ছে টাকার ভিত্তিতে। অর্থাৎ এখানে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের চেয়ে টাকার সম্পর্কটাই প্রধান।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি কলেজের একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা এবং একজন শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close